ইষ্টভৃতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে ৫ম খন্ড

ইষ্টভৃতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে ৫ম খন্ডের ৩৭ পৃষ্ঠায় আলোচনা রয়েছে। নিম্নে তার উল্লেখ করা হলো।

২৬শে বৈশাখ, সোমবার, ১৩৫০ (ইং ১০/৫/১৯৪৩)

……..
নিবারণদা—শাস্তি কাম্য না হ’তে পারে, কিন্তু অপরাধী যদি শাস্তি না পায়, তাহ’লে অন্যে তো অপরাধ করতে উৎসাহিত হ’য়ে উঠবে।

শ্রীশ্রীঠাকুর—সামাজিক ও পারিবেশিক ব্যবস্থাই এমনতর করা লাগবে যাতে মানুষ অপরাধ করবার সুযোগই কম পায়। সমাজে বিয়ে-থাওয়া যদি ঠিকমত হয়, মানুষের শিক্ষা, দীক্ষা ও জীবিকার ব্যবস্থা যদি সুষ্ঠু হয়, অপরাধপ্রবণ মনোবৃত্তি যাদের ভিতর লক্ষ্য করা যায়, তাদের যদি এমনতর কাজকর্ম্ম দিয়ে এমনতর পরিবেশের ভিতর ফেলে রাখা যায়—যেখানে তারা ঐ প্রবৃত্তি-পরিচালনার সুযোগ কমই পায়, তাহ’লে কিন্তু শাস্তি না-দিয়েও তাদের সংশোধন হ’তে পারে। সমাজের কোন-একটা মানুষও বেওয়ারিশ মাল নয়, প্রত্যেকের জন্য সমাজের যথেষ্ট করণীয় আছে। রাষ্ট্র ও সমাজের তরফ থেকে যা’-যা’ করলে মানুষ সুস্থ হয়, স্বাভাবিক হয়, সুনিয়ন্ত্রিত হয়, তা’ না-ক’রে শুধু শাস্তির ব্যবস্থা করলে একপেশে কর্ত্তৃত্ব করা হবে। আমার তো মনে হয়—জন্মগতভাবে অপরাধপ্রবণ ও অযোগ্য যারা, তাদের বংশবিস্তার করবার সুযোগ না-থাকা ভাল। সুবিবাহ ও সুজনন যদি না হয় দেশে, তাহ’লে সারা দেশটাকে জেলখানা করলেও নিস্তার মিলবে না। আর, ঋত্বিক্-আন্দোলন খুব চালাতে হয়। ঋত্বিকরা মানুষের বাড়িতে-বাড়িতে যাবে, আবালবৃদ্ধবনিতাকে সদাচারে ও সদভ্যাসে অভ্যস্ত ক’রে তুলবে। Positively (বাস্তবভাবে) সৎচলনে অভ্যস্ত না হ’লে কোন মানুষই কিন্তু নিরাপদ নয়। যে মন্দও করে না, ভালও করে না, গতানুগতিক চলনে চলে,—সে যে পরিবেশের পাল্লায় প’ড়ে কখন খারাপের দিকে ঝুঁকে পড়বে, তার কিন্তু কোন ঠিক নেই। সেইজন্য আমি কই যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি ও সদাচারের কথা। যজন মানে নিজে ইষ্টবিষয়ক ভাবনা-চিন্তা করা, যাজন মানে অন্যকে প্রবুদ্ধ করা, ইষ্টভৃতি ও সদাচার মানে ইষ্টপোষণী আচার-অনুষ্ঠান হাতে-কলমে করা। সৎচলনে এতখানি ব্যাপৃত থাকলে তবে ব্যক্তিত্বের উপর তার ছাপ পড়ে। সে অসৎপথে তো ঝোঁকেই না, বরং অন্যকে অসৎপথ থেকে সৎপথে ফিরিয়ে আনতে পারে। এটা কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষের অবশ্যকরণীয়। এই আত্মসংশোধনী অবশ্যকরণীয়গুলি যাতে প্রত্যেকের অভ্যাসগত হয়, তার কোন ব্যবস্থা সমাজ বা রাষ্ট্রের তরফ থেকে করা হবে না, দোষ করলে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে, সে তো কোন কাজের কথা নয়। তাতে নৈতিক মানের বাস্তব উন্নয়ন হবে না। অবশ্য, অনিবার্য্যক্ষেত্রে সংশোধনমুখী শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

সুবোধদা—আপনি তো যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি ও সদাচারের কথা বলছেন, কিন্তু বহু পিতামাতা আছেন যাঁরা নিজেরা তো দীক্ষা নেনই না, এমন-কি ছেলেপিলেরা যদি দীক্ষা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে তাতে বাধা দেন। তারপর সেই ছেলেপিলেরা হয়তো কুসঙ্গে মিশে খারাপ হ’য়ে যায়।

শ্রীশ্রীঠাকুর—শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুর বলেছেন, চারাগাছ বেড়া দিয়ে রাখতে হয়। চারাগাছ বলতে আমি বুঝি—যাদের ব্যক্তিত্ব এখনও সুপুষ্ট হয়নি। আর, বেড়া বলতে আমি বুঝি সদগুরু, সৎনাম ও সৎসঙ্গ। মানুষ যদি অল্পবয়স থেকে সদগুরু গ্রহণ করে সৎ-নামের অনুশীলন নিয়ে সৎসঙ্গে অর্থাৎ জীবনবৃদ্ধিদ ভাল পরিবেশের ভিতর বাস করে, তাহ’লেই তার জীবন অনায়াসে সংগঠিত হ’তে পারে। মানুষের জীবন যদি কোন জীয়ন্ত সতে সুনিবন্ধ না হয়, তাহ’লে সে যে নানা আবর্ত্তে প’ড়ে হাবুডুবু খাবে, সে-বিষয়ে কি আর কোন সংশয় আছে?