ইষ্টভৃতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গের ১৭শ খন্ডের ৪১, ২৬৪, ৩০৭ পৃষ্ঠায় আলোচনা রয়েছে। নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলো।
১৭ই বৈশাখ, ১৩৫৬, শনিবার (ইং ৩০/৪/১৯৪৯)
……
ইষ্টভৃতি-স্বস্ত্যয়নী সম্পর্কে কথায় মণিদা বললেন—ইষ্টভৃতি, স্বস্ত্যয়নী করলে এই-এই ভাল হবে, সে লোভ দেখিয়ে মানুষের মধ্যে এ সবের প্রবর্ত্তন করা ভাল নয়।
শ্রীশ্রীঠাকুর—যা’ করলে যা’ হয়, সে-বিধির কথা আমরা লোকের কাছে বলব না কেন? ম্যালেরিয়া রোগীর কাছে ডাক্তার কি বলবে না যে, কুইনাইন খেলে ম্যালেরিয়া সারে? যা’ মঙ্গল বলে জানি, তা’ কেন বলব না? অবশ্য, ইষ্টকে ভালবেসে, ইষ্টের প্রীত্যর্থে যদি কেউ বিধিমাফিক ইষ্টভৃতি ও স্বস্ত্যয়নী করে, তা’ যে সর্ব্বোত্তম সে বিষয়ে সন্দেহ কি? কিন্তু তুমি ঐ যে বলছ, ইষ্টভৃতি স্বস্ত্যয়নীর কার্য্যকারিতা সম্বন্ধে ব’লে লোককে তা’তে প্রবৃত্ত করা ভাল নয়, এটা কোন কাজের কথা নয়। প্রবৃত্তিমুখী যাজন সমাজে এন্তার চলবে অথচ সত্তাপোষণী নীতিবিধি সম্বন্ধে নীরব থাকতে হবে এ কেমন কথা? পণ্ডিতী ছেড়ে নিজের ও অপরের ভাল যাতে হয় বাস্তবে তাই ক’রে চল। ভাল-ভাল গালগল্প করার আসর খুলে বসিনি আমি। দরকার হ’লে রোগীর বুকের উপর হাঁটু গেড়ে ব’সে ওষুধ খাইয়ে রোগীকে সুস্থ ক’রে তুলতে আমি বদ্ধপরিকর। তা’তে লোকে আমাকে যাই বলুক সেদিকে খেয়াল দেওয়ার অবসর আমার নেই। আমি তোমাদের ভালবাসি এবং ছলে, বলে, কৌশলে তোমাদের ভাল করে যাবই। এই-ই আমার জন্ম-জন্মান্তরের নেশা। ইষ্টভৃতি-স্বস্ত্যয়নী ক’রে যে মানুষের কী হয়, সে experience (অভিজ্ঞতা) আমার এত লোকের কাছে শোনা আছে যে তার অন্ত নেই।
প্রচণ্ড তোড়ে কথাগুলি শ্রীশ্রীঠাকুর বলে গেলেন। উপস্থিত সবাই এখন নির্ব্বাক, নিস্তব্ধ এবং এক গভীর ভাবে তন্ময়।
৫ই আষাঢ়, ১৩৫৬, রবিবার (ইং ১৯/৬/১৯৪৯)
……..
শ্রীশ্রীঠাকুর দুপুরে ভোগের পর বড়াল-বাংলোর ঘরে বিছানায় ব’সে আছেন।
পাচুদা (চক্রবর্ত্তী) বিদায় নেবেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—খুব tactfully (সুকৌশলে) চ’লো। যেখানে যেমন চলতে হয়, বলতে হয় তেমনি ক’রো।
শ্রীশ্রীঠাকুর পরে বিষ্টুদা (ব্যানার্জ্জী)-কে বললেন—ইষ্টভৃতির সুফল যে কত, ব’লে শেষ করা যায় না। এতে অসম্ভব কাণ্ড ঘটে। যুদ্ধের সময় বার্ম্মায়, কলকাতার দাঙ্গায়, নোয়াখালির গোলমালের সময় কত লোক যে ইষ্টভৃতি করার ফলে অসম্ভবভাবে বেঁচে গেছে তার হিসেব নেই। তাই ব’লে আমরা যদি ইষ্টভৃতির ফল সম্বন্ধে সন্ধিহান হ’য়ে পরীক্ষা করতে যাই, তাহ’লে কিন্তু ইষ্টভৃতিই ঠিক-ঠিক করা হবে না। তাই ফলের দিক দিয়েও বঞ্চিত হব। Spontaneous urge (স্বতঃস্ফূর্ত আকূতি) থেকে করাতেই ঠিক-ঠিক করা হয় এবং বিপদ-আপদের সময় তার ফলটা টের পাওয়া যায়। ইষ্টভৃতি ক’রে বেরুলে নিকুম্ভিলা যজ্ঞ ক’রে বেরুবার মত হয়। তখন একেবারে invincible (অজেয়)। কলকাতায় যেয়ে লাগ। অসম্ভব কাণ্ড ক’রে ফেলতে পারবে। কোন্ বনে কোন্ বাঘ আছে ঠিক কি?
মন্মথদা (ব্যানার্জ্জী)—আমি দেখেছি যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি ঠিকভাবে না করলে, কোন কাজ ভাল ক’রে করা যায় না।
শ্রীশ্রীঠাকুর—অচ্যুত নিষ্ঠা না থাকলে প্রবৃত্তি মানুষকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। প্রবৃত্তির সঙ্গে জড়ান থাকে হীনম্মন্য অহং। তা’ যে কাকে কখন কোন্ দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তার ঠিক নেই। কিন্তু নিষ্ঠা থাকলে তার সার্থক বিন্যাস হ’তে থাকে, তা’ ধীরে-ধীরে সুনিয়ন্ত্রিত হ’তে থাকে। নীত না হ’লে কেউ নেতা হ’তে পারে না। কেষ্টঠাকুর স্বয়ং ভগবান, তিনিও গুরুগ্রহণ করেছিলেন। আদর্শকে না ধরে সত্যিকার বড় কাজ কৃতকার্য্যতার সঙ্গে করা মুশকিল। অশোক গুরুনিষ্ঠ হয়ে কি বিরাট কাজ করেছিল তা’ত কারও অজানা নয়। অটল বিশ্বাস এবং নিষ্ঠা এই আমাদের সম্পদ। এই সম্পদ থাকলে মানুষ বাইরের সবকিছুকে balanced way-তে (সাম্যসঙ্গতভাবে) utilise (সদ্ব্যবহার) করতে পারে। Environment (পরিবেশ) সুখের সাড়াও যেমন দেয়, দুঃখেরও তেমনি দেয়। নিষ্ঠা থাকলে দুটোই adjust (নিয়ন্ত্রণ) করতে পারে। নচেৎ সাম্য বজায় রেখে চ’লে বড় হওয়া ঘ’টে ওঠে না।
……
৫ই আষাঢ়, ১৩৫৬, রবিবার (ইং ১৯/৬/১৯৪৯)
……
জনৈক দাদা—ইষ্টভৃতি ক’রা সত্ত্বেও যজন-যাজনটা আসে না কেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর—ক’রতে-ক’রতেই আসে। যাজন-মানে তো ভাল কথা কওয়া। মানুষকে সুখ, সুবিধা, শান্তির কথা কয়ে, সেই পথ ধরান। যজন মানে তো তাই পালন করা নিজে। এই তো!
আর এক দাদা বললেন—আমার সব সময় এই কাজ নিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। নিজের প্রয়োজন থাকায় সব সময় পেরে উঠি না।
শ্রীশ্রীঠাকুর—সংসারের প্রতি কর্ম্মের ভিতর-দিয়ে ধর্ম্মকে পরিপালন করা চাই। সাংসারিক কাজ-কর্ম্ম বাদ দিয়ে, ধর্ম তো একটা আলাদা কিছু নয়। আর, বাস্তব জীবনকে বাদ দিয়ে ধর্ম্ম যদি আলাদা কিছু হয়, সে ধর্ম্ম টেকে না।
…….