ইষ্টভৃতি নিয়ে আলোচনা-প্রসঙ্গে ৩য় খন্ড

ইষ্টভৃতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গের ৩য় খন্ডের ১৩৭-১৩৯ পৃষ্ঠায় আলোচনা রয়েছে। নিম্নে সেটা উল্লেখ করা হলো।

০৬ই চৈত্র, ১৩৪৮, শুক্রবার (ইং ২০/০৩/১৯৪২)

শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতে নিভৃত-নিবাসে বিছানায় ব’সে আছেন। এমন সময় নোয়াখালীর চন্দ্রনাথদা (বৈদ্য) আসলেন। চন্দ্রনাথদাকে দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর উল্লসিত হ’য়ে বললেন—’এখানে আইছ ভালই হইছে, তোমার সঙ্গে আমার কথা বলার দরকার ছিল।’ চন্দ্রনাথদা প্রণাম ক’রে নীচেয় বসলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর চন্দ্রনাথদার কাছে বর্ম্মার, বিশেষতঃ সেখানকার যুদ্ধকালীন অবস্থার খবরাখবর জানতে চাইলেন। চন্দ্রনাথদা সংক্ষেপে মোটামুটি খবর বললেন। সেই প্রসঙ্গে বললেন—বিপদের মধ্যে পড়লে আপনার দয়া প্রতি পদে-পদে অনুভব করা যায়।

শ্রীশ্রীঠাকুর—পরমপিতার দয়া মানুষের উপর আছেই। কিন্তু যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি যারা করে—প্রত্যেক কাজে বিহিত কৃতিচলন নিয়ে,—তারা সেই দয়াটা বেশী ক’রে বোধ করতে পারে ও তার সুযোগও বেশী ক’রে গ্রহণ করতে পারে। পৃথিবীতে যত রকম যন্ত্র আছে তার মধ্যে সব চাইতে সেরা যন্ত্র হ’চ্ছে মানুষের শরীর। এই যন্ত্রকে ঘসে-মেজে তেল দিয়ে যত তীক্ষ্ণ, তরতরে ও উপযুক্ত রাখা যায়, ততই সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম জিনিস ধরা পড়ে তা’তে। আবার, ঐ সূক্ষ্ম বোধ ও অনুভূতি-অনুযায়ী ক্ষিপ্রভাবে ক্রিয়া করার শক্তিও গজায় তা’তে। যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি ও ইষ্টানুগ কৃতিচলনে ঐ জিনিসটি হয়। মানুষ যত প্রবৃত্তিমুখী হয়, সে তত blunt (ভোঁতা) ও callous (বোধহীন) হয়, কোথায় কী করতে হবে তা’ ঠাওর পায় না, আর, ঠাওর পেলেও motor-sensory co-ordination (বোধপ্রবাহী ও কর্ম্মপ্রবোধী স্নায়ুর সঙ্গতি) না থাকার দরুন, যেখানে যা’ করণীয় ব’লে বোঝে, ত্বরিত গতিতে তা’ করতে পারে না। এইভাবে বিপদের মাঝখানে গিয়ে পড়ে, কিন্তু অনেক সময় তা’ হ’তে মুক্ত হবার পথ আর খুঁজে পায় না। মানুষ লাখ ধান্ধায় ঘোরে, কিন্তু ইষ্টধান্ধার ধার ধারে না, ওতে কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব বিচ্ছিন্ন হ’য়ে পড়ে। আর, বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্ব বিপর্য্যয়ের সম্মুখীন হ’য়ে আরো বিপর্য্যস্ত হ’য়ে পড়ে। বিপর্য্যয়ের মধ্যেও ত্রাণসূত্র লুকিয়ে আছে কোথায় সেটা আবিষ্কার ক’রে একাগ্রভাবে নিজেকে পরিচালিত করতে পারে না সেই পথে। তখনও প্রবৃত্তির বিক্ষেপ বিভ্রান্ত ক’রে তোলে তাকে। ধর, একজন মানুষ আত্মরক্ষার জন্য একজায়গা থেকে আর-এক জায়গায় পালাচ্ছে, লোকটা যদি মাতাল হয়, আর মাঝখানে যদি একটা মদের দোকান পায়, হয়তো ঢুকে যাবে সেখানে, ভাববে—একটু মদ খেয়ে নিলে শরীরটা চাঙ্গা হবে, তা’তে তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারবে। এই ভেবে মদের দোকানে ঢুকে মদ খেতে বসলো। মদ খেতে ব’সে আর মাত্রা ঠিক রাখতে পারলো না, নেশার ঘোরে সেখানেই প’ড়ে রইলো, পরে ধরা পড়লো সেখানে, এইরকম কত যে হয়, তার কি ঠিক আছে? তাই, যজন, যাজন, ইষ্টভৃতিতে অভ্যস্ত হওয়া লাগে সকলেরই, ওই নিত্য অভ্যাসে সত্তার পালন, পোষণ ও রক্ষণী রসদ মজুত হয় চরিত্রে। ঐ মজুদ রসদই তাকে টিকিয়ে রাখে অসময়ে। যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি যে করে না, ইষ্টধান্ধায় যে সক্রিয়ভাবে ব্যাপৃত থাকে না, বুঝতে হবে, অনিষ্ট অর্থাৎ প্রবৃত্তি তার পিছু নিয়েছে, আর উপযুক্ত সময়ে তার কাজ সে করবেই। তাই, সঙ্কটকাল ছাড়া অনেক সময় বোঝা যায় না, কার বাস্তব সম্বল কতখানি।

প্যারীদা (নন্দী)—যারা এখানে নাম নেয়নি, তারা তো ইষ্টভৃতি করে না। আবার বহুলোক তো আছে, কোথাও দীক্ষা নেয়নি। তারাও তো বিপদে রক্ষা পায়।

শ্রীশ্রীঠাকুর—রক্ষার বিধিকে যে যতখানি পালন করে, ততখানি রক্ষা পায়, তা’ সে নাম নিক্‌ আর না নিক্। একটা মানুষ যদি পিতৃভক্ত বা মাতৃভক্ত হয়, তারও অনেকখানি সম্পদ থাকে। দেখা যাবে, তার চলা, বলা, ভাবা, করা অনেকখানি পিতৃকেন্দ্রিক বা মাতৃকেন্দ্রিক। কেন্দ্রানুগ যজন, যাজন ও ভরণ তার জীবনে থাকেই এবং অমনতর শ্রেয়-অনুসরণের ফল যা’ তা’ থেকেও সে বঞ্চিত হয় না। তবে বিধিমাফিক করার ভিতর-দিয়েই বিহিত ফল লাভ হ’য়ে থাকে। নিয়মিতভাবে ইষ্টভৃতি করার ফল অমোঘ। ইষ্টভৃতি মানে মাঙ্গলিক যজ্ঞ।

প্রফুল্ল—ইষ্টভৃতির বিষয়ে আপনার একটি ছড়া আছে, অতি চমৎকার।

শ্রীশ্রীঠাকুর—কী?

প্রফুল্ল—
ইষ্টভরণ ধান্ধা যাহার
        মগজ থাকে জুড়ে',
সব প্রবৃত্তি ইষ্টার্থে তা’র
        বিনিয়ে ওঠে ফুঁড়ে ;
সমাহারী দীপ্ত নেশায়
        কৰ্ম্ম-সন্দীপনা
ঐ আবেগে অটুট হ'য়ে
      আনে সম্বর্দ্ধনা;
স্থবির স্নায়ুর স্বস্থ-টানে
       চলৎ স্নায়ুর গতি
সংবেদনার সংক্রমণে
       দেয়ই সাড়ার নতি
আত্মম্ভরি দরিদ্রতা
      অলস ঠুনকো মান
অমনি নেশার ক্রমোৎকর্ষে
      লভেই তেমনি ত্রাণ
সংগ্রাহী তা'র এমনি আবেগ
      শক্তি-সরঞ্জামে,
বৃদ্ধি-সহ কুশলতায়
      আপৎকালে নামে
ওড়ে বিপদ ছাইয়ের মতন
      ঝলক দীপন রাগে
সম্পদে সে অটুট চলে
      ইষ্ট-অনুরাগে। ৩১।

শ্রীশ্রীঠাকুর—বেশ তো ছড়াটা। ওর মধ্যে মরকোচ ভাঙ্গা আছে। ইষ্টভৃতির কথা নুতন কিছু না। বেদ, গীতা, বাইবেল, কোরান, সংহিতা সব জায়গায়ই আছে এর কথা। জেমস্-এর কথার মধ্যেও এর আভাস পাওয়া যায়। পঞ্চমহাযজ্ঞের কথা হিন্দু সন্তান আজ ভুলে গেছে। দুর্দশাও তাই আজ ঘিরে ধরছে। ইষ্টভৃতির মধ্যে মোটামুটি জিনিসটা আছে। তাই, ইষ্টভৃতি যদি ভাল ক’রে চারান যায়, মায় ভ্রাতৃভোজ্য ও ভূতভোজ্য ইত্যাদি সহ,—তা’হলে মানুষের চরিত্র, কর্ম্মক্ষমতা ও যোগ্যতা যেমন বাড়ে, তেমনি দুঃস্থদেরও সাহায্যের ব্যবস্থা হয়। বড়-বড় philosophy (দর্শন) মানুষকে না শিখিয়ে ছোট-ছোট টোটকা আচরণ ভাল ক’রে শেখান ভাল। করার ভিতর-দিয়ে যে জ্ঞান হয় সেই জ্ঞানই হয় কার্যকরী। ……