ইষ্টভৃতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গের ৮ম খন্ডের ৩১, ১৫৫, ১৫৮, ১৭৯ পৃষ্ঠায় আলোচনা রয়েছে। নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলো।
০৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৫৩, বুধবার (ইং ২২/০৫/১৯৪৬)
প্রমথদা—ছাত্রসমাজের মনোভাবের পরিবর্ত্তন কীভাবে করা যাবে?
শ্রীশ্রীঠাকুর—সত্যিকার আভিজাত্যবোধ জাগাতে হবে। গোত্রগরিমা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। পাশ্চাত্যের cultural conquest (কৃষ্টিগত বিজয়)-এর ফলে আজ আমরা বলছি—’নাই বা হলাম আর্য্য, নাই বা হলাম ব্রাহ্মণ-সন্তান। ওর দামই বা কী?’ তার মানে আমাদের আভিজাত্য-বোধ নেই। আভিজাত্য মানে অন্যের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ নয়। এর মানে পূর্ব্বপুরুষের সঙ্গে আমার অচ্ছেদ্য সম্পর্কের স্বীকৃতি। আমার পূর্ব্বপুরুষ সংসারে, সমাজে ও জগতে যে-সব মহৎকাজ ক’রে গেছেন, চরিত্রের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন, আমি তার ক্রমাগতি বজায় রাখব, সেই উন্নত চলন হ’তে আমি কিছুতেই স্খলিত বা ভ্রষ্ট হব না—এমনতর সম্বিৎ ও সঙ্কল্প। এই স্মৃতি জাগ্রত থাকলে মানুষ কখনও নীচেয় নামতে পারে না, পিতৃ-পুরুষের মাথা হেঁট হয় এমনতর কাজ করতে পারে না। এই হ’লো জীবনের উন্নয়নী বাঁধন, এ বাঁধন বড় শক্ত বাঁধন, বাইরের চাপে সহজে ছুটে যায় না। বাবা-মার কাছে ছেলে যদি বংশ-গরিমার কথা শোনে, আর সেই সঙ্গে-সঙ্গে যদি দেশের ও জগতের ইতিহাস শেখে, তবে অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা ও গুরুত্ব-বোধ ingrained (দৃঢ়বদ্ধ) হ’য়ে যায়। গায়ের ময়লার মত আলগা হ’য়ে থাকে না, যে সাবান ঘষলে উঠে যাবে। ছেলেপেলেদের উৎস-ঝোঁকা ক’রে তুলতে না পারলে, কিছুতেই কিছু হবে না। পিতৃপুরুষ এবং সেই সঙ্গে-সঙ্গে মা-বাবার প্রতি admiration (শ্ৰদ্ধা) ও adherence (অনুরাগ) না থাকলে higher Ideal (উন্নততর আদর্শ)-এর প্রতিও থাকে না। এটা সংক্রামিত ক’রে দিতে হয়। মা যদি রোজ ছেলেমেয়েকে জিজ্ঞাসা করে—তোমার বাবাকে আজ কী দিলে? বাবাও যদি জিজ্ঞাসা করে—তোমার মাকে কী দিলে?—এইভাবে উদ্দীপনা ও আনন্দের ভিতর-দিয়ে যদি শ্রেয়কে দেওয়ার অভ্যাস গজিয়ে দেওয়া যায়, তা’তে adherence (অনুরাগ) দিন-দিন পুষ্ট হ’তে থাকে। যার জন্য যত করা যায়, তার জন্য তত টান হয়। ইষ্টের প্রতি নেশা বাড়াবার জন্য তাই নিত্য ইষ্টভৃতি করতে হয়। তাঁকে দেব, রোজ দেব, প্রাণ ভ’রে দেব, তাঁকে না দিয়ে আমার পেটে কিছু দেব না। ‘কী দেব তাঁকে? কী দেব তাঁকে?’—এমনতর একটা আকুল আগ্রহ মাথাটাকে পাগল ক’রে তুলবে। এই কৰ্ম্ম-প্রতুল অবদান-আবেগ নিয়ে আসবে psycho-physical concentration (মানস-শারীর একাগ্রতা), meditation (ধ্যান) তখন আপ্সে-আপ্ হ’তে থাকবে। শরীর-মন যদি একবার ইষ্টঝোঁকা হ’য়ে ওঠে তাহ’লে আর চাই কী? এর ভিতর-দিয়েই সব যা’-কিছু grow ক’রে (গজিয়ে) উঠবে ।….
৪ঠা শ্রাবণ, ১৩৫৩, শনিবার (ইং ২০/০৭/১৯৪৬)
…..কথাপ্রসঙ্গে শ্রীমেনন বললেন—আজকালকার পরিবেশে মানুষের ধর্ম্মপথে চলার সুবিধা-সুযোগ কম।
শ্রীশ্রীঠাকুর হেসে বললেন—সুবিধিতে অর্থাৎ সুনিয়মে চলার ভিতর-দিয়ে শুভ বা সু-ফল প্রাপ্তির যোগ আসে। তাই সুবিধা-সুযোগ বিহিত করণ-পরিক্রমার ভিতর দিয়ে পেতে হয়। আবার, অসুবিধাকেও সুবিধা ক’রে নেওয়া যায় বর্ত্তমানে সু-বিধিমত চ’লে। ভাল পাওয়া ও ভাল হওয়া আমাদের ইচ্ছা ও করার মুঠোর মধ্যে। ভালটাকে create (সৃষ্টি) করা লাগবে।
পরে পড়া হ’লো—’অনেক বিদ্যা শিখিল প্রসঙ্গ যদি না বুঝিল, সে বিদ্বানে পোছে কেবা?’
এই কথা শুনে বললেন কখন কোনটা apply (প্রয়োগ) করতে হবে, তার tactics (কৌশল) যদি না জানা যায়, সে বিদ্যে মিছে। পড়ে-শুনে যেটা জানা যায়, তার বাস্তব প্রয়োগ কিভাবে করতে হবে, তা’ শিখতে হয়। আগে গুরুগৃহে থেকে পড়াশুনার সঙ্গে-সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের অবশ্য প্রয়োজনীয় রকমারি কাজের ভিতর দিয়ে যে-শিক্ষাটা হ’তো, তা’ খুব পাকা হ’তো। ঐ যে আচার্য্যের জন্য ভিক্ষা করতে হ’তো,—যা’কে আমি বলি ইষ্টভৃতি, —ওর মধ্য দিয়ে শিখতো—কিভাবে মানুষকে তার প্রয়োজন অনুধাবন ক’রে সেবা দিতে হয়, স্থান-কাল-পাত্র-ভেদে কখন কা’র সঙ্গে কোথায় কেমনভাবে ব্যবহার করতে হয়, যাতে আদর্শও ঠিক থাকে, লোকেও সুখী হয়। আদর্শনিষ্ঠা বাদ দিয়ে যে লোকতোষণ, তাতে কিন্তু ব্যক্তিত্ব বাড়ে না। লোকেও বুঝে নেয়—তার মেকদার কতখানি।….
৫ই শ্রাবণ, ১৩৫৩, রবিবার (ইং ২১/০৭/১৯৪৬)
…..কাল দুপুরে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম—লোকদের কাছে বলছি, ইষ্টভৃতি অর্থাৎ সামর্থ্যীযোগ যদি অধ্যাত্মযোগের সঙ্গে combined (যুক্ত) না হয়, তবে হবে না। অধ্যাত্মযোগ সামর্থ্যীযোগ ছাড়া sterile (বন্ধ্যা)।
পরে ঐ কথার ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—আমরা যা’ই করি, যদি ইষ্টভৃতিরূপ একটা sacramental endowment (পূত অবদান) না থাকে, সব ব্যর্থ। ইষ্টভৃতি হ’লো material concentration (বাস্তব একাগ্রতা)। ভাব-ভক্তির বাস্তব বিনিয়োগ না হ’লে তা’ প্রবহমান জীবন্ত গতি পায় না, স্থায়ী হয় না, মনে উঠে মনেই লয় পেয়ে যায়। ইষ্টভৃতি হ’লো ইষ্টানুরাগের বাস্তব বিনিয়োগ। ….. সামৰ্থীযোগ অধ্যাত্মযোগকে help (সাহায্য) করে, অধ্যাত্মযোগ সামর্থ্যীযোগকে help (সাহায্য) করে। সমগ্রভাবে জীবন বাড়তির পথে চলে। বহু সাধু সন্ন্যাসী যে কিছু করতে পারে না তার কারণ সামর্থ্যীযোগের অভাব। যখনই কোন লোক ইষ্টভৃতি, স্বস্ত্যয়নী বন্ধ করে, প্রায়ই দেখা যায় disaster (বিপর্য্যয়)-এর সৃষ্টি হয়। তার কারণ, চলার গতিটা ও লক্ষ্যটাই upset (বিপর্যস্ত) হ’য়ে পড়ে। বুদ্ধি-বিপর্যয়ের ফলে অপ্রধানটা প্রধান হয়, প্রধানটা অপ্রধান হয়। তাই, ভুলভ্রান্তিও বেড়ে যায়। তা’ছাড়া জীবনপথের আগন্তক বাধাবিঘ্নগুলিকে ভয় করতে যে উদ্বৃত্ত মনোবল ও শক্তির প্রয়োজন হয়, ঐ অবস্থায় তারও যোগান পায় কম। ফলে, ধীরে-ধীরে বেকায়দার বেড়াজালে প’ড়ে যায়।
কেষ্টদা—যারা দীক্ষা নেয়নি কোথাও তারা কী করবে?
শ্রীশ্রীঠাকুর—আমি বলি, ছেলেপেলে শিশুকাল থেকে যাতে বাপ-মাকে দেয়, সেই অভ্যাস করান লাগে। তাতে ability (সামর্থ্য) বাড়ে, মা-বাপের ‘পর ঝোঁক হয়, জীবনে successful (কৃতকাৰ্য্য) হয়। প্রত্যেক দিন দেওয়া উচিত। এটা হ’লো sacramental offer (পূত অবদান), love-offer (প্রীতি-অবদান)-এর মত। ছেলেপেলের মধ্যে বাপ-মাকে রকমারি জিনিস দেওয়ার ধান্ধা ও ইচ্ছা গজিয়ে দেওয়া দরকার। এতে দেখবেন, family (পরিবার)-কে family (পরিবার) কেমন enriched (সমৃদ্ধ) হ’য়ে উঠছে। কওয়া লাগে—বাবা! তোমার মাকে কিছু দাওনি? তিনি দেবতার চাইতেও বড়। তাঁকে দিলে ভগবান খুশি হন। মার আবার কওয়া লাগে—তুমি আমাকে দিলে, তোমার বাবাকে কিছু দিলে না? তিনি তো আমারও পূজার পাত্র। তাই বোঝ, কত বড় তিনি তোমার কাছে। তাঁকে দিতে পারা তো ভাগ্যের কথা!…এইভাবে নেশাটা গজিয়ে দেওয়া চাই। compulsion (জোরাজুরি) হ’লে হবে না। দিয়ে ভাল লাগান চাই। এইসব ছেলের যখন গুরুকরণ হবে, তখন গুরুর প্রতিও এরা অটুট-টানসম্পন্ন হবে।
পরে জপধ্যান ও ইষ্টভৃতির সম্পর্ক-সম্বন্ধে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—Psychic concentration (মানসিক একাগ্রতা) ও material concentration (বাস্তব একাগ্রতা)-এর common point (অভিন্ন বিন্দু) হলেন ইষ্ট। পরিবেশকে নিয়ে সত্তার সম্বেগ, মস্তিষ্ক, শরীর, মন এই সবগুলিকে ইষ্টের দিকে সমতালে কেন্দ্রীভূত ও উদ্বর্দ্ধিত ক’রে তোলাই সাধনা। তাতে সব দিকই রক্ষা পায়। Equilibrium (সমতা) নষ্ট হয় না।
কেষ্টদা বললেন—উইলিয়াম জেম্স্ বলেছেন—মানুষের আছে sensory nerve (বোধস্নায়ু), motor nerve (কর্ম্মস্নায়ু) ও central nervous system (কেন্দ্রীয় স্নায়ুবিধান)। এই তিনটে দিকেরই উৎকর্ষসাধন প্রয়োজন, নচেৎ জীবন ক্ষুণ্ণ হয়।
এ-কথা শুনে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—হ্যাঁ! সেটা ঠিক।…..
২১শে আশ্বিন, ১৩৫৩, মঙ্গলবার (ইং ০৮/১০/১৯৪৬)
….শ্রীশ্রীঠাকুর পরে এসে বড়াল-বাংলোর বারান্দায় ব’সে বাংলার বিভিন্ন জিলার দাদাদের কাছে সে-সমস্ত জায়গার খবরাখবর নিতে লাগলেন।
সব কথা শুনে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—সৎসঙ্গী এবং সেই সঙ্গে-সঙ্গে অন্যান্যদের খোঁজখবর রাখবে। কেউ যাতে বিপন্ন না হয়, সেইদিকে লক্ষ্য রাখবে। সঙ্কটজনক অবস্থায় যারা আছে, তাদের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে এনে রাখবে। দীক্ষিতের সংখ্যা যাতে বাড়ে, তা’ করাই চাই। প্রাণ বিপন্ন, এই বোধে যা’ করতে হয় করবে। কয়েকটা মানুষ পাগল হ’লেই যথেষ্ট। নিত্য পাঁচ টাকা ক’রে ইষ্টভৃতি করতে পারে, এমনতর পঁচিশ হাজার লোক ঠিক করতে হবে। তা’ছাড়া, প্রত্যেকে তার কর্ম্মশক্তি ও উপার্জ্জন-ক্ষমতাকে বাড়িয়ে maximum amount (সর্ব্বোচ্চ পরিমাণ) ইষ্টভৃতি যাতে করে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। ইষ্টভৃতি এমন একটা জিনিস, যাতে পুরুষকারের সঙ্গে দৈবের সম্মিলন হয়। এই দুৰ্দ্দিনে শুধু দৈববলেও হবে না, শুধু পুরুষকারেও হবে না। এই দৈব ও পুরুষকারের combined effect (সমন্বিত প্রভাব)-কে বাড়িয়ে তুলতে ইষ্টভৃতি-সম্বন্ধে আরো বেশী আগ্রহ ও একাগ্রতা-সহকারে প্রচেষ্টাপরায়ণ হওয়া লাগবে। তা’ছাড়া, এর ফলে তোমাদের সমবেত অবদানের উপর দাঁড়িয়ে মানুষকে বাঁচাবার জন্য অনেক কিছু করা যাবে। মানুষের প্রকৃত ইচ্ছা ও সঙ্কল্প যদি জাগে, তাহ’লে প্রতিকূলতার মধ্যেও যে কী অসাধ্য সাধন করতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলেন নেতাজী। অসুস্থ অবস্থায়, নিঃসম্বল একক একটি মানুষ, বিদেশ বিভুঁইয়ে কী কাণ্ডটাই ঘটিয়ে তুললেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ ও আজাদ হিন্দ সরকারের কীর্তিকলাপের কথা যত শোনা যায়, ততই মন আনন্দে নেচে ওঠে। তোমরাও যদি পরমপিতার ইচ্ছা-পূরণের জন্য, লোকের কল্যাণের জন্য পিছটান ছেড়ে সৰ্ব্বস্ব পণ ক’রে লাগ, তাহ’লে তাঁর দয়ায় অসম্ভব সম্ভব হবে।