ইষ্টভৃতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গের ৯ম খন্ডের ১১০, ১৩৫, ১৮৯ পৃষ্ঠায় আলোচনা রয়েছে। নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলো।
১৯শে ভাদ্র, শুক্রবার, ১৩৫৪ (ইং ০৫/০৯/১৯৪৭)
…..
শ্রীশ্রীঠাকুর—লোভ জিনিসটাই বিশ্রী। ওতে মানুষকে খতম ক’রে দেয়। আমি দেখেছি, যারা আমার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেওয়ার লোভ করে, তারাই ঠ’কে যায়। যারা কেবলই নিতে থাকে, তাদের একটা গিঁট প’ড়ে যায়। নিজেরা আর উঠতে পারে না। যারা শুধু দেয়, তারা ঠেলে ওঠে—দেওয়ার urge-ই (আকুতিই) ক্যাল-ক্যাল ক’রে বাড়িয়ে দেয় তাদের। শ্রেয়কে দেওয়ার বুদ্ধি ও অভ্যাস থাকলে, তাই-ই মানুষকে যোগ্য ক’রে তোলে। স্বপ্ন দেখেছিলাম—ইষ্টভৃতি হ’লো সামর্থ্য-যোগ – psycho-physical devotion (মানস ও শারীর ভক্তি)
দৈনন্দিন জীবনে সত্তাপোষণী সদভ্যাস গঠনের সুফল সম্বন্ধে উইলিয়াম জেমস্ যে- কথা বলেছেন—ভেবে দেখেন তা’ কতখানি সত্যি। বার্ম্মায় যুদ্ধ হ’লো, কলকাতায়, নোয়াখালিতে এত দাঙ্গা হ’লো—ইষ্টভৃতিওয়ালারা এর মধ্যে কিন্তু কমই suffer করেছে (দুর্ভোগ ভুগেছে)। অর্থ মানুষের কাছে এতখানি প্রিয়, তার কারণ তা’ দিয়ে একদিকে যেমন হয় জীবনধারণ, অন্যদিকে তেমনি হয় প্রবৃত্তি-তোষণ। সেই প্রিয় বস্তু কিংবা তার বিনিময়ে প্রাপ্ত কোন কিছু নিত্য ইষ্টার্থে উৎসর্গ করা মানে ইষ্টকে নিজ জীবনে সব চাইতে প্রিয় ক’রে তোলার প্রয়াস নিয়ে চলা। নিষ্ঠাসহকারে কেউ যদি এটা করে, তার একটা অকাট্য ফল ফলে তার শরীর ও মনের উপর। বিপদের সময় সেটা বিশেষ ক’রে ধরা পড়ে।
কেষ্টদা—গত বৎসর ১৬ই আগষ্ট কলকাতায় যে ব্যাপার ঘটে গেল, সে-সময় বহু সৎসঙ্গী miraculously (অলৌকিকভাবে) saved হ’য়ে (রক্ষা পেয়ে) গেছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর—কে যেন তখন ঐভাবে রক্ষা পেয়ে ১০০ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল।
মদনদা (দাস)—স্বস্ত্যয়নী-ইষ্টভৃতি ছেড়ে দিলে পাহাড় থেকে ফেলে দেবার মতো অবস্থা হয়।
শ্রীশ্রীঠাকুর—তার মানে তখন প্রবৃত্তিপরতন্ত্রী intellectual obsession (বুদ্ধিগত অভিভূতি) হয়। Brain (মস্তিষ্ক) ঐভাবে obsessed (অভিভূত) হ’লেই danger (বিপদ) আসার সম্ভাবনা। যখনই দেখবে ইষ্টের ধান্ধা মাথা থেকে স’রে যাচ্ছে, অন্য ধান্ধা প্রবল হ’য়ে উঠছে আর তাতে মত্ত হ’য়ে ইস্টের জন্য করাটা বাদ প’ড়ে যাচ্ছে, তখনই ধ’রে নিও তুমি দুষ্টগ্রহের পাল্লায় প’ড়ে গেছ। ঐ অবস্থায় জোর ক’রে নিজেকে ইষ্টার্থী চলনে ও করণে ব্যাপৃত ক’রতে হয়। তাতে দুর্ভোগ অনেক কমে। আমি অনেক সময় মানুষকে খামাকা এক-একটা কাজের কথা বলি। যখন যাকে যেটা ক’ রতে বলি, সব অসুবিধা সত্ত্বেও সে যদি তাই নিয়ে উঠে-প’ড়ে লাগে, তাই নিয়েই যদি সব সময় দেহ-মনে ব্যস্ত থাকে, তবে অনেক কাটান পেয়ে যেতে পারে। আর, যারা স্বতঃই ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠায় উদ্দাম হ’য়ে চলে—সক্রিয় তৎপরতায়,—লাখো কৰ্ম্মবিপাক যে তাদের কেমনভাবে উলটে-পালটে যায়, তা’ তারা ঠাওরই পায় না। ঝড়ঝাপ্টা যে না আসে তা’ নয়, কিন্তু তা’ তাদের কাবু করতে পারে কমই। কারণ, তাদের মন থাকে ইষ্টে, আর বিপদকালে তাই-ই তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হ’য়ে দাঁড়ায়।
রত্নেশ্বরদা (দাশশর্মা)—এ-সব কথা জানা-বোঝা সত্ত্বেও যে আমাদের বুদ্ধিবিপর্য্যয় হয়?
শ্রীশ্রীঠাকুর—যাইহোক—ইষ্টসেবা থেকে বিরত হ’তে নেই কোনকালে। আর, ইষ্টসেবা ক’রতে গেলেই পরিবেশের সেবা ক’রতে হয়—ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠায় নজর রেখে। নিজের স্বার্থ বড় ক’রে দেখতে গেলেই নিজের স্বার্থ খোয়ান হয়—এই হ’লো বিধির বিধান। এই সত্য যে না-জেনেছে, সে হ’লো বেকুব-বর্ব্বর। মানুষের মগজে এটা ভাল ক’রে ঢুকিয়ে দেওয়া চাই এবং তা’ এমন গভীরভাবে যাতে সে কিছুতেই তা’ না ভোলে। বহুদিন ধ’রে যদি মানুষ লাগা-জোড়াভাবে ইষ্ট-প্রধান চলনে না চলে, তাহ’লে কিন্তু এই বোধ মাথায় ধ’রে রাখতে পারে না।…..
৭ই আশ্বিন, বুধবার, ১৩৫৪ (ইং ২৪/০৯/১৯৪৭)
……
সেকেন্ড অফিসার—চেষ্টা ক’রলেই কি মানুষকে ধর্ম্মপ্রাণ ক’রে তোলা যায়?
শ্রীশ্রীঠাকুর—আমাদের চরিত্র ও আচরণে যদি ধৰ্ম্ম ফুটে ওঠে, তবেই আমরা ধর্ম্ম সঞ্চারণার যোগ্যতা লাভ করি। বাঁচতে চায় না, বৃদ্ধি পেতে চায় না, এমন মানুষ খুব কম। কিন্তু obsession (অভিভূত)-এর দরুণ অনেকেই চলে উল্টো পথে। ও একরকমের disease (রোগ)। মানুষের শরীর রুগ্ন হ’লে, তাকে সুস্থ ক’রে তোলার জন্য আমরা কত চেষ্টা করি। কিন্তু passionate (প্রবৃত্তিপরায়ণ) চলনরূপ মহাব্যাধি যে মনুষ্য সমাজকে ক্ষয় ক’রে দিচ্ছে, তার চিকিৎসার জন্য আমরা কী করছি? আগেই বা কী ক’রেছি? আর, ভগবানকে যদি ভালবাসি, তাঁর জন্য তো কিছু করা লাগে। কিছু অন্ততঃ করি! তাঁর অত্যন্ত প্রিয় কাজ হ’চ্ছে যাজন। এ-বড় সুখের কাজ। এতে ভগবানও প্রীত হন, নিজেও প্রীত হওয়া যায়, মানুষকেও প্রীত ক’রে তোলা যায়, আবার সঙ্গে-সঙ্গে পরিবেশকে নিয়ে নিজে শাতনের হাত থেকে পরিত্রাণলাভের সুযোগ পাওয়া যায়। শাতন মানে, যে আমাদের নাকি পতন, পাতন, ছেদন, ক্ষয় ও বিনাশ ঘটায়। মানুষ যখন ভক্তিযুক্ত চিত্তে যাজনে রত থাকে তখনকার মতো অন্ততঃ সে ও যাজিত উভয়েই শাতনের হাত থেকে রেহাই পায়। তাই যজন, যাজন যত বেশী চলে ততই সমাজের আবহাওয়া পবিত্র হয়। কেউ যদি সর্ব্বদা ঐ কামে লেগে থাকে, ধীরে-ধীরে সে দেবতুল্য স্বভাব পায়। ওর সঙ্গে আর একটা কাজ আছে, সেটা হ’লো ইষ্টভৃতি। রোজই ভগবানের উদ্দেশ্যে বাস্তবে কিছু নিবেদন ক’রতে হয়। এতে ভগবানের ‘পর, ইষ্টের ‘পর টান খুব বেড়ে উঠতে থাকে। ইষ্টকেন্দ্রিক এই আগ্রহসন্দীপ্ত দৈনন্দিন করাগুলিকে অবলম্বন ক’রে ধর্ম জাগ্রত হ’য়ে ওঠে ব্যষ্টি ও সমষ্টির জীবনে। নইলে ধৰ্ম্ম কথার কথামাত্র থেকে যায়। তা’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে না মানুষের জীবনে। ধৰ্ম্ম মানে that which upholds the life and growth, being and becoming of every individual with his environment (তাই যা’ পরিবেশ-সহ প্রতিটি ব্যক্তির জীবন ও বৃদ্ধিকে ধারণ করে)। আমরা পরিবেষণ ক’রছি শয়তানকে, ভগবানকে তো পরিবেষণ ক’রছি না, তাই দুৰ্দ্দৈব। মানুষ যখন মানুষের ক্ষতি করে, মানুষ যখন মানুষকে মারে, তখন সে যে নিজের কতখানি ক্ষতি করে, নিজেকে কতখানি মারে—তা’সে বোঝে না। এই অজ্ঞতার নিরসন ক’রতে হবে। মানুষের চোখ দুটো খুলে দিতে হবে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে। অক্লান্তভাবে তা’ যারা ক’রবে ঈশ্বরের প্রীতিচুম্বন তাদের অমৃত-অভিসিঞ্চিত ক’রে তুলবে।…
২১শে অগ্রহায়ণ, রবিবার, ১৩৫৪ (ইং ০৭/১২/১৯৪৭)
……
শ্রীশ্রীঠাকুর—ভাল হওয়ার জন্য সব সময় নিজেকে যতটা শাসনের উপর রাখা লাগে, তাই যে আমরা রাখতে চাই না।
এরপর কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—ইষ্টভৃতি হ’লো practical materialised condensed form of psycho-physical ascetic devotion (শারীর- মানস তপস্যাপরায়ণ ভক্তির কার্য্যকরী বাস্তব সংক্ষিপ্ত রূপ)। ইষ্টভৃতি ঠিক-ঠিক ভাবে করতে গেলে তা’ অর্থভাবনা-সহ জপও আনে, সঙ্গে সঙ্গে আনে ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠামূলক মনন সমন্বিত ধ্যান। ইস্টের ভরণ-পূরণ করতে গেলে কায়মনোবাক্যেই তা’ করতে হয়। শরীরটা মানুষের বড় জীবন্ত বাস্তব জিনিস, কোন ব্যাপারে আগ্রহ সহকারে শরীরটাকে নিয়োজিত করলে মন, বাক্যও তার পিছু-পিছু ছোটে। একটা মানুষ রোজ ভোরে উঠে যদি শুদ্ধাচারে ভক্তিভরে ইষ্টভৃতি করে, তাহ’লে তার ভিতর-দিয়ে এতখানি extra-energy (অতিরিক্ত শক্তি) stored (সঞ্চিত) হয় যে, তার উপর দাঁড়িয়ে সে-সব বিপদ-আপদকে easily overcome (সহজে অতিক্রম) করতে পারে। অন্য মানুষ যেখানে ভেঙ্গে পড়ে, সেখানে সে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
কেষ্টদা—যদি ছেলের অসুখ সারবে, এই আশায় কেউ ইষ্টভৃতি করে?
শ্রীশ্রীঠাকুর—Tempting attitude (প্রলুদ্ধ করার মনোভাব) থাকলে সবই নিষ্ফল হ’য়ে যায়। বাইবেলে আছে Do not tempt Lord thy God (তোমার প্রভু ঈশ্বরকে প্রলুদ্ধ ক’রো না)। ঠাকুর! রোজ আমি ইষ্টভৃতি করি, আমি তোমার অনুগত, তুমি আমার রোগটা সারিয়ে দাও। রোগ যদি সারে, তাহ’লে বুঝব তোমার দয়া আছে আমার উপর। ইষ্টভৃতির মাহাত্ম্য আছে। রোগ সেরে গেলে বেশী করে ইষ্টভৃতি করব’—এমনতর সর্ত্তকন্টকিত অবদানে Supreme Being (পরমপিতা) টলেন না, Satan (শয়তান) টলতে পারে। ঐ সর্ত্ত ও প্রত্যাশাই তাঁর দয়া পাওয়ার পথে barrier (বাধা) সৃষ্টি করে। ভগবান ভালবাসেন সকলকে equitably ( যথোপযুক্তভাবে), কিন্তু আমরা প্রত্যাশাহীন হ’য়ে তাঁকে যতখানি ভালবাসি, ততখানি আমাদের তাঁকে পাওয়া হয়, তাঁকে পাওয়া মানে স্ববৈশিষ্ট্য- অনুযায়ী তাঁর রকমে রূপান্তরিত হওয়া। ঐ চরিত্র যেখানে মজুত হয়, সেখানে জীবনীয় লওয়াজিমার অভাব হয় না। গীতায় আছে কৰ্ম্মফল ত্যাগের কথা। ইষ্টভৃতি হ’লো বাস্তব কৰ্ম্মফল ত্যাগ। কাজের ফলে যা’ পেলাম তার অগ্রভাগ গুরুকে দিলাম। এর ক্রমাগতি ও ক্রমবিস্তারে ভগবান আপনাদের কাছে উদ্ভিন্ন হ’য়ে উঠবেন আপনাদের গুরুর ভিতর দিয়ে, যেমন কেষ্টঠাকুর হয়েছিলেন অৰ্জ্জুনের কাছে।
“একভক্তিবিশিষ্যতে”। একনিষ্ঠ না হ’লে হয় না। বহুনৈষ্ঠিকতা নিষ্ঠুর ব্যাভিচার ছাড়া আর কিছু নয়। ওকে নিষ্ঠাই কয় না। সবাইকে ভালবাস, শ্রদ্ধা কর, কিন্তু devotion (ভক্তি) concentrate (কেন্দ্রীভূত) কর এক জায়গায়। Traffic love (ব্যবসাদারী ভালবাসা) ভাল নয়।
প্রফুল্ল—Traffic love (ব্যবসাদারী ভালবাসা) কেমন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — যেমন ধর, একজন স্বার্থ বাগাবার আশায় বহু সাধুর কাছে যাচ্ছে, খুব ভক্তি দেখাচ্ছে, কিন্তু কাউকে অনুসরণ করে না।
কেষ্টদা— চারিদিক হ’তেই তো মানুষ তার প্রয়োজনীয় যা’-কিছু তা’ আহরণ করবে। এরমধ্যে গুরুর প্রয়োজন কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর—একজনকে অনুসরণ না করলে আহরণগুলি বিচ্ছিন্ন হ’য়ে থাকবে। মালার আকারে গেঁথে উঠবে না। মালা গাঁথার সূত্র হলেন ইষ্টগুরু। I love all with the love of my one (একের প্রতি আমার যে ভালবাসা, তাই নিয়ে আমি সকলকে ভালবাসি)। ঐরকম একজন এক যদি আমার জীবনে না থাকেন, যাঁকে নিয়ে আমার জীবনের সর্ব্বক্ষেত্রে সর্ব্বদা চলি, তাহ’লে আমার জীবনে কখনও ঐক্যসঙ্গতি আসবে না। কতরকমের অসঙ্গতি ও পরস্পর-বিরোধী ভাব যে আমার উপর আধিপত্য ক’রে আমাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ক’রে তুলবে, তার ইয়ত্তা নেই। তাই গুরু চাই-ই, আর চাই গুরুনিষ্ঠা। গুরুনিষ্ঠা নিয়ে, গুরুগত প্রাণ হয়ে যা’-কিছু করতে হবে। বৈষ্ণবরা কয় কেষ্টঠাকুর যাতে ভাল থাকেন, সেইজন্য নাকি গোপীরা কাত্যায়নী পূজা করেছিল। ইষ্টার্থে যা’ করা যায়, তাই-ই পবিত্র, তাই-ই পূণ্য।