ইষ্টভৃতি নিয়ে দীপরক্ষী ৪র্থ খন্ড

ইষ্টভৃতি নিয়ে দীপরক্ষী ৪র্থ খন্ডের ২৩ পৃষ্ঠায় আলোচনা রয়েছে। নিম্নে তা দেয়া হলো।

৩রা চৈত্র, সোমবার, ১৩৬৪ (ইং ১৭/৩/১৯৫৮)

…..
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ কাটে। তারপর বেদানন্দ ঝা বললেন—সংসারে কোন জায়গায় তো শান্তি পাই না। তাই এখানে ছুটে-ছুটে আসি। আমি তো ইনকাম-ট্যাক্স অফিসার। কতটুকু tax (কর) নিয়ে যেতে পারব তার চেষ্টা করি।

শরৎদা—এখানে যে tax (কর) পাওয়া যায় তা’ most valuable tax (অত্যন্ত মূল্যবান কর)।

শ্রীশ্রীঠাকুর—এখানে প্রত্যেকটা মানুষকেই আপনার ক’রে নেওয়া লাগে। আপনি সেদিন বললেন পঞ্চমহাযজ্ঞের কথা। তার মধ্যে আছে নৃযজ্ঞ, মানে নরযজ্ঞ। এটা লোককল্যাণ করার জন্য রাজাকেও দেওয়া যায়। কিন্তু এটা হওয়া চাই স্বতঃস্ফূর্ত্ত auto-taxing (স্বতঃ-করদান)। এখানে জোর ক’রে tax (কর) বসাতে গেলে সেটা হবে লোকসান। (শরৎদার দিকে তাকিয়ে) আপনি ইষ্টভৃতি করেন রোজ সকালে। তার ভিতর-দিয়ে জীবনের কল্যাণ হয়। ওটা হ’ল জীবনযজ্ঞের প্রথম আহূতি। ওটা করতেই হয়। অবশ্য ইষ্টভৃতি বাদ দিয়ে যদি আপনি নৃযজ্ঞ করেন সেটা কিন্তু ঠিক হবে না। জেম্স্, নাকি বলেছেন ইষ্টভৃতির কথা। রবি ঠাকুরও নাকি ধরেছেন। এই চুনী, বইখানা ওকে দেখাতে পারিস্ নাকি?

চুনীদা—জেমস্-এর বই?

শ্রীশ্রীঠাকুর—হ্যাঁ।

চুনীদা বই আনতে উঠে গেলেন। আবার পূর্ব্বপ্রসঙ্গ ধ’রে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—বর্মায় যখন bombing (বোমা পড়া) সুরু হ’ল তখনকার গল্প শুনলে অবাক হ’য়ে যেতে হয় যে কী ক’রে সেখানকার সৎসঙ্গীরা বাঁচল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রহ্মদেশে সেই বিপর্য্যয়কালে সৎসঙ্গীরা কিভাবে শুধু অস্খলিত নিষ্ঠার সঙ্গে ইষ্টভৃতি পালন ও অটুট বিশ্বাসের বলে রক্ষা পেয়েছে, কেষ্টদা সে-গল্প ক’রে শোনালেন বেদানন্দ ঝাকে। তারপর কথাপ্রসঙ্গে বললেন—ঠাকুর ধর্ম্ম বলতে শুধু নিজের উন্নতি বোঝেন না, সাথে-সাথে environment-এর (পরিবেশের) উন্নতির কথাও বলেন।

শ্রীশ্রীঠাকুর—আমার আচার্য্য সবকিছুর প্রতীক। সমস্ত environment (পরিবেশ) আচার্য্যের মধ্যে lodge (বাস) করে, আবার আচার্য্যও সমস্ত environment-এর (পরিবেশের) মধ্যে lodge (বাস) করেন। সেজন্য আমাদের পরিবেশে ব্যক্তিগতভাবে যদি আমরা environment-এর (পারিপার্শ্বিকের) সেবা না করি তাহ’লে আচার্য্যের সেবা সেখানে ব্যর্থ হবে।

শ্রীঝা—পরমাত্মাও তো তাতে তৃপ্ত হন না।

শ্রীশ্রীঠাকুর—পরমাত্মা শুধু, ফাঁকিতে নেই তো, বাস্তব করার মধ্যে আছেন। আর, আত্মা মানেই হ’ল গতিশীলতা, motive power (চলচ্ছক্তি)।

বেদানন্দ ঝা তাঁর লেখা একখানা বই ছাপতে দিয়েছেন সৎসঙ্গ প্রেসে। অমূল্য ঘোষদা ছাপছেন সেখানা। কাছে অমূল্যদাকে দেখে শ্রীঝা বই ছাপা কতদূর হ’ল সে সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। কথার শেষে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—ও আর একটা প্রেস আনার চেষ্টায় আছে। এখনই আনত, কিন্তু টাকার কমতি প’ড়ে গেল। টাকা যা’ ছিল, সবই এদিকে-ওদিকে building (দালান) তৈরীতে খরচ হ’য়ে গেল। ওরা ছাপে খুব ভাল। কলকাতার অনেক প্রেস থেকে ভাল ছাপা।

বেদানন্দ ঝা-এর সঙ্গী ভদ্রলোকটি কেষ্টদার কাছে সৎসঙ্গের ইংরাজী পত্রিকা কী আছে দেখতে চাইলেন। কেষ্টদা ‘লাইগেট’ ও ‘বিকামিং’-এর কথা বললেন এবং এক কপি ক’রে আনিয়ে দিলেন ওঁদের।

কেষ্টদা—(শ্রীঝাকে) আপনি ব’লে বিদ্যাপতির translation (অনুবাদ) করছেন?

শ্রীঝা উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠে বললেন—না, না।

শ্রীশ্রীঠাকুর—কেষ্টদার কথাটা কিন্তু ভাল। বিদ্যাপতির translation (অনুবাদ) করতে পারলে ভাল হয়।

কথায় কথায় অনেকক্ষণ সময় পার হ’ল। চুনীদা এখনও বই নিয়ে এলেন না দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর বিশেষ ব্যস্ত হ’য়ে পড়লেন। একজন সংবাদ নিয়ে এল, চুনীদা বইটা খুঁজে পাচ্ছেন না। শরৎদা তাড়াতাড়ি যেয়ে তাঁর নিজের লেখা ‘যুগবাণী’ বইখানা নিয়ে এসে সেখান থেকে শ্রীশ্রীঠাকুরের ঈপ্সিত, জেম্স্-এর কোন সদভ্যাস-অনুশীলনের অপূর্ব ফলের কথাগুলি বের ক’রে প’ড়ে শোনালেন। (এই কথাগুলি আছে উইলিয়ম জেমস্-এর Selected Papers on Philosophy নামক পুস্তকের Habit chapter-এ)।

পড়ার শেষে শ্রীশ্রীঠাকুর বেদানন্দ ঝাকে বললেন—এটা ক’রে দেখবেন রোজ সকালে উঠে, দেখবেন কেমন লাগে।

শ্রীঝা—আচ্ছা।

এইবার ওঁরা দু’জনে উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় প্রার্থনা করলেন।