শ্রীদেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সঙ্কলিত দীপরক্ষীতে একটি ঘটনা পাওয়া যায়। ঘটনাটি এরূপ…
দীপরক্ষী ১ম খন্ড – ১৭ই বৈশাখ ১৩৬০ (১লা মে, ১৯৫৩)
শ্রীশ্রীঠাকুর বিকালে যতি-আশ্রমে দক্ষিণাস্য হ’য়ে ব’সে আছেন। ননীদা (চক্রবর্ত্তী), যতীনদা (দাস), শরৎদা (হালদার) প্রমুখ যতিবৃন্দ উপস্থিত আছেন। কিছুদিন আগে শচীনদার (গাঙ্গুলী) পুত্রের মৃত্যু হয়েছে ইলেক্ট্রিক শক্ লেগে। শচীনদা শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে ব’সে শোক প্রকাশ করছেন। তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে নানা কথা বলছেন শ্রীশ্রীঠাকুর। কথাপ্রসঙ্গে বললেন—
শ্রীশ্রীঠাকুর– শুচ্, ধাতু মানে শোক করা, আবার পবিত্র হওয়া। শুচ্ মানে ক্লেদবিসারকও হয়, অর্থাৎ যে ক্লেদটা জমে, সেটাকে সরিয়ে দেয়। যার ব্যক্তিত্ব যতখানি strong (শক্তিমান), সে environment (পরিবেশ)-কে ততখানি mould (নিয়ন্ত্রণ) করতে পারে। এই যে আমার মেয়ে সাধনা মারা গেল। বড়-বৌ এসে ঘরে ঢুকল কিন্তু একটা gorgeous (চকমকে ) রকমে । ওর ঐ অবস্থা দেখে আমারও শোক সেরে গেল। অভিমন্যুবধের পরে অর্জ্জুনের শোকাবেগ হয়েছিল। ঐ অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণ আসলেন, অৰ্জ্জুনকে elated ( উদ্দীপ্ত) করলেন। যার ঠেলায় অৰ্জ্জুন কত অক্ষৌহিণী সেনা ধ্বংস ক’রে ফেলল। সেইরকম হওয়া লাগে—’আজি রণে কর্ণ বধ প্রতিজ্ঞা আমার’।
দীপরক্ষী ১ম খন্ড – ১৮ই বৈশাখ ১৩৬০ (২লা মে, ১৯৫৩)
শচীনদা (গাঙ্গুলী) নিজ পুত্রের অকাল মৃত্যুর কথা বলছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে–
শচীনদা — কর্ম্মফল কি অমোঘ ?
শ্রীশ্রীঠাকুর—যে-কৰ্ম্ম করি তার ফলভোগ করাই লাগে। যেমন, অনেকে ম্যাজিক দেখাতে গিরে কাঁচ খায়, নাইট্রিক এসিড খায়। কিন্তু খেলে খাওয়ার যে ক্রিয়া তা’ হবেই ।
শচীনদা—যখন আমার কর্ম্মফল ভোগের সময় আসে, তখন আর কিছুতেই আপনার কথা শুনি না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর- তার মানে আপনি ভক্ত না, যে-ভক্তি সম্পূর্ণভাবে তাঁতে অনুরক্ত থাকে। যে করে তার হয়। Sincerity (ঐকান্তিকতা )-কে যদি profitable (লাভের ) না করতে পারেন তাহ’লে হয় না ।
শচীনদা— ‘তুমিময়’ মানে কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর—’ময়’ মানে এই কথা যে, আমার সমস্ত প্রবৃত্তিগুলি তাঁতে অনুরক্ত হবে। প্রীতিটা কিন্তু সৌজন্য নয়কো, —টান। ঐ টান-অনুপাতিক কৰ্ম্ম ও কৰ্ম্ম-ফলগুলিও সব ঐ পথে adjusted ( বিনায়িত) হ’য়ে আসে। কাউকে যদি আমি ভালই বাসি, তবে তার জন্য কষ্ট ক’রে আমার সুখ মনে হয়। ঠিক interest (অন্তরাস) grow করা (জন্মানো) চাই। যেমন আপনার ছেলের কথাই কই। তার যে ইলেক্ট্রিক শক লাগল, পায়ে যদি তার রবারের জুতো থাকত তাহলে তার শক লাগলেও বেঁচে উঠত। তাই, তার করাগুলি ঠিক বিন্যস্ত হয়নি।
শচীনদা—সে কেন সাবধান হয়নি ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — হয়নি তার মানে ঐ রকমটা ঠিক ছিল না ।
শচীনদা – ছয় বছর ধরে কাজ করছে, তবু, তার এ-রকম ভুল হয় কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর— হয়তো মাঝে-মাঝে জুতা পরত না। …….. ভাল তোমার যতই হোক, তার মধ্যে যদি চার আনা খারাপ থাকে, তবে সেই চার আনাই whole (সমস্ত )-টাকে নষ্ট করে। এই যে আমার মেয়ে সাধনা। তার মেয়ে হওয়ার পরে শরীর খুব ভাল হল। তার ছবিও বোধ হয় আছে। সেই সময় আমি বললাম—ওকে পাঁচ বছর শ্বশুরবাড়ী যেতে দিও না। বড়বৌ সে-কথা শুনল। আমি আরো বললাম—ওর যদি এখন আবার conception ( গর্ভসঞ্চার ) হয় তবে কিছুতেই বাঁচবে না। ওর শ্বশুরবাড়ীর সবাই শুনে বলল- ‘কী, মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, শ্বশুরবাড়ী পাঠাবে না?’ তারপর জামাই এসে নিয়ে গেল। তারপরেই তো এই কাণ্ড। আমার কি কোন ক্ষমতা আছে? যেমন আপনার ছাওয়ালের উপরে আপনার কোন ক্ষমতা নেই, তেমনি মানুষের উপরেও ভগবানের কোন ক্ষমতা নেই । জগন্নাথের কোন হাত নেই মানে হল ভগবানের কোন ক্ষমতা নেই।
( একটু পরে) এমনি এক-একটা মানুষ আসেন তাঁরা ক’য়ে যান, কেঁদে যান, ব্যথা পান। যারা করে তারা পায়, হয় । যারা করে না— তারা পায় না, হয় না। তাঁর চরণধুলি আমরা নিই। চরণধূলি নয়, চলনধুলি। তাঁর সেই চলনে আমাদের চলতে হয়। যদি সেই চলনে চলতে পারি, তাহলে আমার আয়, যা’ আছে তা’ বেড়ে যেতে পারে।
এথেকে বোঝা যায় যে, ভগবান আসেন, চলার পথ দেখিয়ে যান, নিয়ম বলে দিয়ে যান; যদি আমরা সেই অনুসারে চলি তবেই মঙ্গল। নতুবা নয়।