সত্যানুসরণ -এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
“এটা খুবই সত্য কথা যে, মনে যখনই অপরের দোষ দেখবার প্রবৃত্তি এসেছে তখনই ঐ দোষ নিজের ভিতরে এসে বাসা বেঁধেছে। তখনই কালবিলম্ব না ক’রে ওই পাপপ্রবৃত্তি ভেঙ্গেচুরে ঝেঁটিয়ে সাফ্ ক’রে দিলে তবে নিস্তার, নইলে সব নষ্ট হ’য়ে যাবে।“
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীশ্রীপিতৃদেব বসওয়ানদাকে (সিং) হিন্দীতে আলোচনা করার আদেশ দিলেন। বসওয়ানদার আলোচনা শেষ হতেই তিনি প্রশ্ন করলেন (উপস্থিত দাদাদের উদ্দেশ্যে)—আর প্রশ্ন আছে না-কি?
নিত্যানন্দদা (মণ্ডল)—অপরের দোষ দেখার প্রবৃত্তি থেকে কিভাবে নিজের ভেতর সে দোষ এসে বাসা বাঁধে?
পরমেশ্বরদা (পাল) আরও একটু গোড়ার কথা তুলে প্রশ্ন করলেন—আমি যদি দেখি কেউ অন্য কাউকে মারছে তাহ’লে একজন অন্যজনকে মারছে—এ-রকম তো দেখবই। এতে দোষ দেখার কি আছে?
ততক্ষণে ননীদা (চক্রবর্তী) এসে বসেছেন। শ্রীশ্রীপিতৃদেবের নির্দেশে তিনি উত্তর দিতে শুরু করলেন।
ননীদা—দোষ দেখার প্রবৃত্তি আসার অর্থ এই নয় যে ঘটনা যা’ ঘটছে তা’ আমি দেখব না বা আমার তা দেখা উচিত নয়। দোষ দেখার প্রবৃত্তি আসার অর্থ, ঐ দোষের ধ্যান করা—যার ফলে আমার স্বভাব আমার অলক্ষ্যে নিন্দিত হ’য়ে পড়ে। আর ঐ দোষ ধ্যান করার ফলে আমার মধ্যে তা’ এসে বাসা বাঁধে।
শিবদয়ালদা—কিভাবে ঐ দোষ ঝেঁটিয়ে সাফ করা যায়?
ননীদা—এর জন্য ইষ্টানুগ চলন চাই।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—বাণীটা আমার জন্য ভাবতে হয়। সব জিনিসের মধ্যে ভালমন্দ দুই-ই আছে। সাপের বিষে মানুষ মরে। আবার, সাপের বিষে বিষনাশও হয়। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি। আত্মশুদ্ধি নিজেকেই করতে হয়। কী করলে ঐ ভাবটা (অপরের দোষ দেখার ভাবটা) কেটে যায়, তাই করতে হয়। এখানে ঝাঁটা দিয়ে বাড়ির আবর্জনা ফেলার মতো ব্যাপার তো নেই। ভেতরের ঐ-ভাব (অপরের দোষ দেখার ভাব) যা’ করলে কেটে যায় তাই করতে হবে—ননীদা তাই বলতে চাচ্ছেন।
পরমেশ্বরদা আবার প্রশ্ন তুললেন।—কারও যদি দোষই না দেখলাম তাহলে অসৎনিরোধ হয় কি ক’রে?
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ঐ দোষ না দেখার প্রবৃত্তি থেকেই অসৎ-নিরোধ হয়। অসৎ-নিরোধ করতে হবে, অসৎ-বিরোধ নয়।
ভবানীদা—আজ্ঞে, প্রথমে নিজের অসৎ (অসৎ বৃত্তির) নিরোধ করতে হয়। আমার যে অসৎ প্রবৃত্তি আছে আমি প্রথমে তাই নিরোধ করব। আমি যদি অসৎ-নিরোধ নিজের ওপর না করি তাহলে অন্যদের ক্ষেত্রে অসৎ-নিরোধ কিভাবে করব?
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, এই ধর, আমার ছেলে আমার পকেট থেকে টাকা নিয়ে কোন দুঃস্থকে দিয়ে দিল। আমি তা’ দেখে মুগ্ধ হলাম। কিন্তু তা’ না হ’য়ে যদি তাকে রেগে বলি, কেন সে আমায় না ব’লে ঐ টাকা নিয়ে নিল—তাহ’লে কি হবে? সে হয়তো আমাকে বলতে সময় পায়নি। তার (ঐ দুঃস্থের) অবস্থা দেখে অভিভূত হয়েছিল। তাই আর উপায় না দেখে ও-রকম কাজ (পকেট থেকে টাকা বের করা) করেছিল। এখন যদি তাকে সঙ্গে-সঙ্গেই রাগারাগি করি তাহ’লে ঐ আনন্দ—তার ঐ মহানুভবতা লক্ষ্য ক’রে যে আনন্দ হয় ঐ আনন্দ আর পাওয়া যাবে কি?. . . অসৎ-প্রবৃত্তি নিজের মধ্যে যা’ আছে তা’ থেকে মুক্ত থাকতে হয়। ঝেঁটিয়ে সাফ্ করা মানে তার প্রশ্রয় না দেওয়া।
কথাপ্রসঙ্গে আসামের গৌহাটীতে কামাখ্যা দেবীর মন্দিরের কথা বললেন শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ওখানকার (কামাখ্যা দেবীর মন্দিরের) পাণ্ডারা অনেকেই উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু কি সুন্দর ব্যবহার মানুষের সঙ্গে! কেউ মন্দির দর্শনে এলে কিংবা দেবীর পুজো দিতে এলে টাকা নেওয়ার কথাই বলে না। বরং দরকার হ’লে ধার দেয়। ওদের ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায় কেন এত লোক যায় ওখানে।
তেমনি ঠাকুরের কাছেও মানুষ আসত। তাঁর ভালবাসায় মুগ্ধ হ’য়ে মানুষ যেতে চাইতো না। এই ভালবাসাই হ’ল hypnotize করার (মোহিত করার) শক্তি । ভালবাসাতেই মোহিত হয় মানুষ । ভালবাসার মত আর শক্তি নেই।
আর দোষ দেখার প্রবৃত্তি থাকলে ভালবাসার রাজ্যে ঢোকাই যায় না। এ সম্পদ সম্পর্কে কোন জ্ঞানই হয় না।
[ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-৭/১২/৭৫ ইং]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ৩৪, ৩৫]