অবিশ্বাসী ও বহুনৈষ্ঠিকের … পারে না। – ব্যাখ্যা

সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:

অবিশ্বাসী ও বহুনৈষ্ঠিকের হৃদয়ে ভক্তি আসতেই পারে না।

পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :

শ্রীশ্রীবড়দা—একবার শিব দেবতাকে, একবার কালী দেবতাকে প্রণাম তো অনেকেই করে, বেশ ভক্তি ক’রেই করে। এতে ভক্তির কি অসুবিধা?

নিত্যানন্দদা—ভক্তির ভেতর থাকে নিষ্কাম-কর্ম্ম। ভক্তি মানে তো সেবা। ওখানে নিষ্ঠা আসতে পারে না।

শ্রীশ্রীবড়দা—ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না। দুর্গেশ, বুঝেছিস না কি?

দুর্গেশদা—না।

নিত্যানন্দদা—নিষ্ঠা মানে লেগে থাকা। বহুনিষ্ঠা মানে তো—বহুতে লেগে থাকা।

শ্রীশ্রীবড়দা—হিন্দুদের দেখি তো, বারো মাসে তেরো পার্ব্বন—লক্ষ্মী, দুর্গা, গণেশ, কার্তিক কত কি? সে সম্বন্ধে আলোকপাত করতে পার না? এগুলোকে কি তুলে দিতে হবে? তুমি উদাত্তকন্ঠে ব’লে দেবে আর তাই আমরা বুঝে নেব?

নিত্যানন্দদা—আমি সবাইকে পূজা করি—তা হবে কেন?

শ্রীশ্রীবড়দা—কেন? সকালবেলা উঠেই আমি ঠাকুর প্রণাম করি, মা-বাবাকে প্রণাম করি . . . এগুলো বাদ দিতে হবে? বারো মাসেই তেরো পার্ব্বন করি, ও বলতে সাহস পাচ্ছে না, এগুলো বাদ দিতে হবে কি না। অনেকের মুখে শুনি ঠাকুর ছাড়া আর কাউকে বুঝি না। পূজা করি তো ঠাকুর ছাড়া আর কাউকে করব না।

নিত্যানন্দদা—একজনকে ভালোবাসলে, অন্যকে দরকার হবে না।

শ্রীশ্রীবড়দা—অবিশ্বাসী ও বহনৈষ্ঠিকের বিষয়টা ব্যাখ্যা ক’রে বুঝিয়ে দাও।

নিত্যানন্দদা—ব’লতে পারছি না।

শ্রীশ্রীবড়দা—‘আসতেই পারে না’—force দিয়ে বলছেন ঠাকুর। তার আগের বাণীটা কি আছে?

নিত্যানন্দদা—”আসল-ভক্তি-যুক্ত মানুষ উপদেষ্টার আসন নিতে একেবারেই গররাজি” —তার আগে—“সৎ-এ নিরবচ্ছিন্ন থাকাটাই ভক্তি”

শ্রীশ্রীবড়দা—ঐ-টা ভাল ক’রে বুঝিয়ে বল।………….
—(সব নিরুত্তর), কই বল।

নিত্যানন্দদা—আমি যখন ইষ্টকে ভালোবাসি, তাঁর নির্দেশ পরিপালন করি, তখন তাঁর সঙ্গে সম্বন্ধ আছে ব’লে—সবাইকে ভালোবাসি।

শ্রীশ্রীবড়দা—প্রথমে ভক্তিটা আরম্ভ হ’লো কেমন ক’রে—সেইটা বল।

নিত্যানন্দদা—প্রথমেই পিতা-মাতার ওপরে ভক্তি।

শ্রীশ্রীবড়দা—প্রথমেই, জ্ঞান হ’তে না হতেই নিঃস্বার্থভাবে আমাকে যিনি পালন করেন সেখানেই সাধারণ টান—তারপর বাবা, শেষে দেখি ঠাকুমা, সব এমনি ক’রে একটা স্বাভাবিক শ্রদ্ধার exercise হয়। শেষে—কালী, দুর্গা—সবকে শ্রদ্ধা ক’রতে বোঝানো হয়। আবার, এমনও হয় নানারকম ঘটা করে লক্ষ্মীপূজা করছি, সরস্বতী পূজা করছি, এখানে ওখানে মানত করছি—এদিকে ঠাকুরের ফটোটা ধুলোয় পড়ে আছে। যে নিষ্ঠা ঠিক রাখতে চায় তাকে আগে ঠাকুরের হতে হবে।

বসাওনদা—সকলের জন্য করি, সকলের জন্য মন কাঁদে, সেটা বহুনৈষ্ঠিকতা নয়।

জিতেনদা—তারা তাঁর মূর্ত্ত প্রতীক।

শ্রীশ্রীবড়দা—দেব-দেবী যা কিছু আমার ভক্তি-প্রীতি বাড়িয়ে দেবার জন্য। অনেক সৎসঙ্গী শিবমন্দির দেখে, কেউ প্রণাম করে। প্রণাম করে আর ভাবে, তাঁর সৃষ্ট সবাইকে শ্রদ্ধা করা লাগবে। যারা ইষ্টকেন্দ্রিক হ’য়ে থাকে, তার ঘরে হয়ত যীশু, কালী, দুর্গার ছবি আছে। তার হৃদয় পূর্ণ হ’য়ে থাকে ভক্তিতে। হয়ত সবাইকে আলাদা-আলাদা পূজা করে না। আমাদের বাড়ীতে ঠাকুরমা ইষ্টদেবতার পূজা করতেন, প্রথা অনুযায়ী অন্যান্য বিগ্রহকে পূজা করতেন। ঠাকুরকে একদিন একজন বললে—ইস্ট পেয়েছি, এখন গোপাল, কালী—এদের কি গঙ্গায় ফেলে দেব? ঠাকুর লাফায়ে উঠে বললেন—বলিস কি? সে কি কথা!

যামিনী—দুর্গাপূজা ইত্যাদি অনেকের বংশের প্রথা বা পুজা—নষ্ট করতে চায় না ব’লে অনেকে করে।

শ্রীশ্রীবড়দা—আবার ইষ্টকে ধ’রে, কেমন ক’রে তা চ’লে যায় বুঝতে পারে না—এরকমও আছে।

[‘যামিনীকান্ত রায়চৌধুরীর দিনলিপি/তাং-২০/৪/৭২ ইং]

[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ২২৮ – ২২৯]