সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
একানুরক্তি, তীব্রতা ও ক্রমাগতিতেই জীবনের সৌন্দর্য্য ও সার্থকতা।
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সরমা আলোচনা করুক।
সরমা—একানুরক্তি মানে একের প্রতি আসক্তি। তীব্রতা মানে বেড়ে যাওয়া। ক্রমাগতি মানে ক্রমশঃ বেড়ে যাওয়া, একানুরক্তি অর্থাৎ ঠাকুরের প্রতি অনুরক্তি বা ইষ্টের প্রতি টান। ইষ্টের প্রতি টান থাকবে। সেই টান যত বেড়ে চলবে ততই জীবনের সৌন্দর্য্য ও সার্থকতা।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তীব্রতা মানেও বেড়ে যাওয়া, আর ক্রমাগতি মানেও বেড়ে যাওয়া?
সরমা চুপ ক’রে থাকে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তীব্রতা মানে প্রখরতা।
সরমা—যতই আমার ইষ্টের প্রতি টান বেড়ে চলবে ততই জীবনের সৌন্দর্য্য ও সার্থকতা আসবে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—কেন? একানুরক্তি মানে একের প্রতি টান। তীব্রতা মানে প্রখরতা। কিন্তু এতে জীবনের সৌন্দর্য্য ও সার্থকতা আসে কেমন ক’রে? তীর্য বল।
তীর্য বলার চেষ্টা করল। কিন্তু কথা পরিষ্কার হ’ল না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—একটা উপমা দিয়ে বুঝিয়ে দাও, জীবনের সৌন্দর্য্য ও সার্থকতা কী? জীবনই বা কী?
তীর্যকে চুপ ক’রে থাকতে দেখে তিনি অতসীকে একই প্রশ্ন করলেন।
অতসী—একানুরক্তি মানে একের প্রতি টান, মানে ইষ্টের প্রতি টান। তীব্রতা মানে প্রখরতা।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ওসব তো বলা হয়েছে। কিন্তু জীবনের সৌন্দর্য্য ও সার্থকতা আসে কী ভাবে?
অতসী চুপ থাকায় তিনি প্রীতোষকে বলতে বললেন।
প্ৰীতোষ—ঠাকুরের কাজ করছি। সেই কাজ করতে গিয়ে যদি অন্যজনের কাজ করি তাহলে দুটো কাজ করতে গিয়ে সার্থক হ’তে পারি না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ঠাকুরের কাজ কেন? অন্য কাজও তো করতে পারি। ঠাকুর কি শুধু সৎসঙ্গীদের চলার জন্য বাণী দিয়েছেন? ঠাকুর যা’ বাণী দিয়েছেন তা’ শুধু সৎসঙ্গীদের জন্য নয়, পৃথিবীর সবার জন্য।
প্রীতোষ—আমি গান শিখতে গেলাম, আবার পড়াশুনাও আরম্ভ করলাম। এতে গান শেখা হ’ল না, পড়াও হ’ল না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—অনেকেই ভাল গান করে, আবার পড়াশুনাও করে। ভাল গায়, ভাল পড়ে, ভাল খেলে—এরকম দেখা যায় না?
প্রীতোষ—একানুরক্তি মানে একের প্রতি টান। যদি আমি পড়াশুনা করি তাহলে মন দিয়ে তাই করতে হবে। ক্রমে-ক্রমেই যদি আমি আরও-আরও করতে থাকি তাহলেই জীবনের সৌন্দর্য্য ও সার্থকতা আসবে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তুমি হয়ত লেখাপড়ায় খুব ভাল, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হ’লে। লোকে বলতে লাগল, এ খুব ভাল ছেলে। খুব ভাল result (ফল) করেছে। এসব সবাই বলতে লাগল। তাতেই কি জীবনের সৌন্দর্য, সার্থকতা আসে? গুছিয়ে বলতে হবে তো!
সতীশদা (পাল)—জীবনের সৌন্দর্য্য তা-ই যাতে মানুষ আকৃষ্ট হয়। আর সার্থকতা আসে তখনই যখন অর্থপূর্ণ হয়। ইষ্টের প্রতি টান থাকলেই এই সৌন্দর্য্য ও সার্থকতা আসে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—একের প্রতি টান থেকেই হয়। মার প্রতি টান থেকেও হয়। টান—মা-বাবার প্রতি টান, ইষ্টের প্রতি টান।
সতীশদা—বিদ্যাসাগরের জীবনে যেমন হয়েছিল।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব— ও (প্রীতোষ) যা’ বলল তাতে হয় না? হয়ত একজন ভাল লেখাপড়া করল, ভাল result করল। কিংবা ধর, কেউ খুব ভাল খেলে। সবাই তার খেলার প্রশংসা করে। তাহলেই কি জীবনের সার্থকতা? হয়তো বাবা-মা ছেলের ভাল result (পরীক্ষার ফল) দেখে খুশি হলেন। তাহলে হয় না?
সতীশদা—যদি বাবা-মাকে খুশি করাই জীবনের উদ্দেশ্য হয় তাহলে হয়।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ভাল result করল, তারপর ভাল চাকুরী পেল, সবাই ভাল বলতে লাগল, এ-রকম হ’লে হয় না?
সতীশদা—আজ্ঞে না, তা’ হয় না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—কেন হয় না?
সতীশদার উত্তর সকলের নিকট স্পষ্ট না হওয়ায় শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—ও (সতীশদা) ক’চ্ছে যে, পাস-টাস করলেও ভাল হয়। কিন্তু ও ছাড়াও যে কিছু আছে সেটা ভুললে চলবে না। প্রীতোষ যে উদাহরণ দিল তা’ও অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে কোন শ্রেয়জনের প্রতি তার টান নিশ্চয়ই আছে।
পরমেশ্বরদা (পাল) জনৈক বিখ্যাত নৃত্যশিল্পীর কথা তুললেন। বললেন—কয়েকদিন পূর্বে খবরের কাগজে দেখেছি তিনি একখানা বাড়ী নিয়ে সম্পূর্ণ একাকী থাকতে চান—পারিবারিক অশান্তিতে ভুগছেন।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব (বিরক্তি সহকারে)—তাতে কী হয়েছে?
পরমেশ্বরদা—আজ্ঞে তার জীবনে আদর্শ থাকলে এবং ঐ আদর্শের প্রতি টান থাকলে এমন হতো না। ইষ্টের প্রতি অনুরাগ না থাকলে জীবনে দুঃখ কষ্ট আসে, সার্থকতা আসে না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—দুঃখ-কষ্ট তো থাকবেই। সংসারে থাকতে গেলেই দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা ভোগ করতেই হয়। ঐ নৃত্যশিল্লীর শেষজীবনে দুঃখ-কষ্ট ছিল বলেই যে তার জীবন সার্থক হয়ে ওঠেনি, তা বলা যায় না। তিনি তো সারাজীবন ধ’রে ভারতীয় শিল্পসংস্কৃতির প্রচার, গঠনমূলক শিল্পসৃষ্টি ও শিক্ষাদান করে গিয়েছেন। শিল্পীমহলে যথেষ্ট সমাদর লাভ করেছেন। কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও ধৈর্যসহকারে তিনি এগুলোর অধিকারী হয়েছেন। এগুলো শিক্ষার ক্ষেত্রেও তিনি কাউকে অনুসরণ করেছেন। তাছাড়াও তাঁর কোন আদর্শ বা ইষ্ট না থাকলে কি এতবড় হতে পারেন?
এখানে একানুরক্তি মানে—আদর্শের প্রতি অনুরক্তি, টান। ঐ আদর্শ বাবা, মা, শিক্ষক বা সদগুরু হ’তে পারেন। আবার, বাবা- মা’র প্রতি টান থেকেই মানুষ গুরুকরণ করে—সদগুরু লাভ করে। ঈশ্বর প্রাপ্তিও হয় এ পথ ধরেই। তাই জীবনের যে কোন পর্যায়ে সাফল্যলাভের মূলে থাকে ঐ একের প্রতি তীব্র টান বা ভালবাসা। ঐ টান মানুষকে টেনে ওপরে নিয়ে যায়—span of life (জীবনের সীমা) বেড়ে যায়। জীবন ভরপুর হ’য়ে ওঠে—আমি এরকম বুঝি।
[ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-২৫/১০/৭৬ ইং]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ২৯১ – ২৯২]