কথায় আছে ….. লক্ষণ।-ব্যাখ্যা

সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:

কথায় আছে “বীরভোগ্যা বসুন্ধরা”! তা’ ঠিক ; বিশ্বাস, নির্ভরতা আর আত্মত্যাগ এই তিনটিই বীরত্বের লক্ষণ।

পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :

শ্রীশ্রীপিতৃদেব বাণীটি আলোচনা শুরু করতে বললেন।

শ্রীকণ্ঠদা প্রশ্ন করলেন—আত্মত্যাগ কী?

সুধীরদা (রায়চৌধুরী)—আত্মত্যাগ মানে নিজেকে উৎসর্গ করা।

শ্রীকণ্ঠদা—কিন্তু কোথায় উৎসর্গ করা?

সুধীরদা—ইষ্টের চরণে নিজেকে উৎসর্গ করা।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সেটা কি রকম?

সুধীরদা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু বক্তব্য পরিষ্কার না হওয়ায় শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—আত্মত্যাগ মানে নিজের যা-কিছু সব ইষ্টের চরণে সমর্পণ করা—ইষ্ট ছাড়া আলাদা আমার কিছু নেই। সবই তাঁর দয়ায় হচ্ছে, সুতরাং সবই তাঁর—এ-ভাব। এবার বিশ্বাস আর নির্ভরতা কা’কে বলে আলোচনা কর্‌।

শ্রীকণ্ঠদা—তিনি (ইষ্ট) যা’ বলেন তা’ ঠিক—এ-ভাব হ’ল বিশ্বাসের ভাব।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—আর নির্ভরতা মানে?

সুধীরদা—তিনি আছেন; সুতরাং আমার কোন ভয় নেই, কোন চিন্তা নেই—এইভাব মনে-প্রাণে পোষণ করাই হ’ল নির্ভরতা।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—শ্রীকণ্ঠ কী বলে?

শ্রীকণ্ঠদা—সব তাঁর, এটা আমি বিশ্বাস করি। সব-কিছু নিয়ে তাঁর (ইষ্টের) সেবা করা, তাঁকে ভরণ করা—এটাই নির্ভরতা।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সে তো বুঝলাম। আরও সহজ ক’রে কিভাবে বুঝব? তাঁরই সব—এটা যদি আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, তাহলে নির্ভরতা আসে কিভাবে?

নিত্যানন্দদা (মন্ডল)—নির্ভরতা মানে তাঁর (ইষ্টের) উপর নির্ভর ক’রে ব’সে থাকা নয়—তাঁর জন্য করা। তিনি যা’ বলেন তা’ ঠিক, তা’ সত্য—এটা আমি বিশ্বাস করি। এই বিশ্বাস থেকেই তাঁর নির্দেশ পালন করার ইচ্ছা জাগে, তাঁর কাজ করার প্রেরণা পাই। তাঁর প্রতি বিশ্বাস রেখে প্রতি মুহূর্তে তাঁর জন্য করার যে ভাব তাই নির্ভরতা।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব এবার হরিপদদাকে (দাস) কিছু বলার নির্দেশ দিলেন।

হরিপদদা—তিনি যা’ বলেন তা’ আমার মঙ্গলের জন্য বলেন। এ-ভাব নিয়ে তাঁর পথে এগিয়ে চলাই হ’ল নির্ভরতা।

আলোচনার সূত্র ধ’রে সুধীরদা (রায়চৌধুরী) বলতে শুরু করলেন—ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলাম—কী করব? আমার তখন খাওয়াই জোটে না; একটা কারখানায় দিনমজুরীতে কাজ করি। ঠাকুর আমাকে দেখে বললেন—কারখানা করা লাগে । ঠাকুরের কথা শুনে অবাক্‌ হলাম। কি করব ভেবে পাই না। কিন্তু ঠাকুর বলেছেন, সুতরাং হবেই—এও ভাবছি। তারপর আস্তে-আস্তে টাকা-পয়সা জোগাড় হয়ে গেল—loan(ঋণ) পেয়ে গেলাম। কারিগর জুটে গেল। কিছুই ছিল না—কারখানা ক’রে ফেললাম। Order আসতে লাগল। তাঁর (ঠাকুরের) কথা বিশ্বাস করেছিলাম, তাঁর উপর নির্ভর করেছিলাম, আর তাই সব হ’য়ে গেল। কোথা দিয়ে কিভাবে হ’ল ভাবতেও অবাক লাগে।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—এর মধ্যে আবার কথা আছে। তাঁর অনুশাসনবাদ যদি না মেনে চলি তাহ’লে তাঁর আশীর্বাদ পেয়েও তা’ পাওয়া হবে না। কিন্তু তাঁকে যদি বিশ্বাস করি, তাঁর অনুশাসনবাদ মেনে চলি তাহ’লে আর সবই ঠিক-ঠিক হয়।

নির্ভরতা প্রসঙ্গে পরমেশ্বরদা (পাল) প্রশ্ন তুললেন—বানরের বাচ্চা তার মা-কে ধরে থাকে, কিন্তু বিড়ালের বাচ্চাকে তার মা নিজেই ধ’রে থাকে। এ দু’য়ের মধ্যে কোনটা আমাদের অনুসরণীয়।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ঠিক-ঠিক অনুরাগী হ’লে বানরের বাচ্চা আর বিড়ালের বাচ্চার মধ্যে বিশেষ তফাৎ নেই—এ বোধ হয়। বানরের বাচ্চা মা-কে ধ’রে থাকে। বিড়ালের বাচ্চাও মা-কে ধ’রে থাকে সূক্ষ্মভাবে। এই যে বানরের বাচ্চা—মনে হচ্ছে, খুব ধ’রে আছে কিন্তু হাত ছেড়ে দিলেই ব্যস, প’ড়ে যায়। তাঁর শক্তিতেই আমি তাঁকে ধ’রে আছি। তাঁর দয়াতেই যা’-কিছু সব করছি। এই ভাব prominent (মুখ্য) হ’লেই বিড়ালের বাচ্চার ভাব এসে পড়ে । আবার যখন ভাবি তিনি আমার আশ্রয়দাতা, তিনি আমাকে আগলে রেখেছেন তখন তাঁকে খুশি না ক’রে অন্য কিছু করার কথা ভাবতেই পারি না। তিনি ছাড়া আমি চলতেই পারি না। তাই যা’-যা’ ক’রলে তিনি তৃপ্ত হ’ন তা’ করার অভ্যাস আমাকে পেয়ে বসে। এই ভাবটাই বানর-ছানার ভাব।

শুধু ধরার ব্যাপার। তাঁকে কেমনভাবে ধরব সেটাই দেখার। শুধু acceptance (গ্রহণ)-এর ব্যাপার। কোনটা বড়, কোনটা ছোট এ-রকম বিচার করা ঠিক না। যে যে-ভাব নিয়েই চলুক, গন্তব্য সেই এক।

কথা-প্রসঙ্গে অর্জুনের কথা উঠল। শ্রীকণ্ঠদা জিজ্ঞাসা করলেন—অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের সখা, তবু তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে বিষাদে মুহ্যমান হলেন কেন?

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—বিষাদ করছেন মনে হ’লেও প্রকৃতপক্ষে তা’ তাঁর মহানুভবতা। কিন্তু এটাও একটা complex (বাধা)। এটাকেও ভেদ করা লাগে। শ্রীকৃষ্ণ সেইজন্যই বললেন, (যুদ্ধক্ষেত্রে) মারার তুমি কে? সব আমি ক’রেই রেখেছি। আবার দেখ শিখণ্ডীকে দেখে ভীম্ম অস্ত্রধারণ করেননি। এটাও একটা বাধা। কিন্তু ইষ্টস্বার্থ পরিপূরণে সৎ ও অসৎ-এ কোন বাধা থাকে না। সৎ-অসৎ-এর ঊর্ধ্বে ওঠাই হ’ল চরম গতি।

আবার দেখ, অর্জুন এতখানি তৈরী হয়েছিলেন যে শেষ পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে দিব্যচক্ষু দিয়ে বিশ্বরূপ দেখালেন। তখন তার ভাঁবই আলাদা। ঠাকুর যখন সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে কথা বলতেন তখন এমন একটা ভাবের সৃষ্টি হ’ত যে, তা’ বর্ণনা করা যায় না। তখন বাইরে থেকে লোক ঢোকা বন্ধ হ’য়ে যেত। ভেতরে (ঘরের ভেতরে) তখন খুব কম লোকই থাকত। একের পর এক কত কথা হ’ত—কত অনুভূতির কথা। এমনিই কেউ যদি অনুরাগের সাথে ঠাকুরের কাছে প্রেম-ভক্তির কথা বলত, ঠাকুর যেন লাফিয়ে উঠতেন।

[ ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-২৮/১১/৭৩ ইং ]

[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ২৫০-২৫২]