সত্যানুসরণ -এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
“কাজ ক’রে যাও, কিন্তু আবদ্ধ হ’য়ো না। যদি বিষয়ের পরিবর্ত্তনে তোমার হৃদয়ে পরিবর্ত্তন আসছে বুঝতে পার, আর সে-পরিবর্ত্তন তোমার বাঞ্ছনীয় নয়, তবে ঠিক জেনো, তুমি আবদ্ধ হয়েছ।“
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
বাণীটি বিভিন্ন ভাষায় পাঠের পর নিয়মমত ছেলে ও মেয়েরা তিনজন করে পাঠ করল এবং শ্রীত্রীপিতৃদেব স্বপ্নাকে (চৌধুরী) আলোচনা করতে বললেন। স্বপ্না বাণীটি পুনরায় পড়ে বলল—এখানে ঠাকুর বলছেন, আমি যদি কোন কাজ করতে যাই, সেই কাজ করব কিন্তু আবদ্ধ হব না । আবদ্ধ হয়ো না মানে কোন বন্ধন না রাখা।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—একটা কাজ বল্। উদাহরণ দে।—ধর্, একটা সমিতি হল, সকলে টাকা-পয়সা দিচ্ছে— একটা ফান্ড হয়েছে। ক্রমে কাপড়-চোপড় তৈরি করা আরম্ভ করল, সকলে যাতে শেখে—সকলে যাতে নিপুণ হয়ে ওঠে—সেই সংকল্প ব্রতী হল। কিছুদিন যেতে যখন সমিতি বড় হল তখন কিসে টাকা বেশি হবে সেদিকে মন গেল, যাকে দিলে ভাল তাকে দিচ্ছে না, লোকে যাতে নেয় তেমন কোয়ালিটি (গুণযুক্ত) করছে না। উদ্দেশ্য ছিল সকলে যাতে শেখে, নিপুণ হয়ে ওঠে সে সংকল্প থেকে দূরে সরে গেল। বিষয়ের পরিবর্তনে তার পরিবর্তন হয়ে গেল। কিন্তু ওটা তো তোমার বাঞ্ছনীয় নয়, তোমার বাঞ্ছনীয় সকলকে নিপুণ করা। তা যখন না-হয়ে টাকা-পয়সায় আবদ্ধ হয়ে যাও তখন ঐ রকম হয়। তুই একটা বল্ (অন্নদা-দাকে)।
অন্নদা-দা (মাঝি)—দুমকায় ঠাকুরবাড়ি তৈরি করলাম, এত ফিল্ড তৈরি করলাম—ঠাকুর অন্য জায়গায় যেতে বললেন, তখন বললাম—আমি অন্য জায়গায় যাব? মন খারাপ হয়ে গেল। আবদ্ধ হয়ে গেলাম।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, ঠিকই। অন্যকে বড় করার বুদ্ধি নাই—সংকল্প থেকে বিচ্যুতি ঘটল। সংকল্প বুদ্ধি থাকা দরকার, তা না হলে go-between (কথার খেলাপ) হয়ে যায় ।—বিষয় মানে কি টাকা-পয়সা?
অন্নদা-দা—সবই হতে পারে। যে ঘটিটায় চান করি, হঠাৎ বদলে গেল, অসুবিধা বোধ হচ্ছে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ঈষৎ হেসে বললেন—ঠাকুর যে-পথে চলতেন, হঠাৎ সেই পথ বদলে গেলে—তিনি আবার ফিরে সেই আগের রাস্তায় আসতেন। যে ঘটিতে জল খেতেন তা না হলে অসুবিধা হত—তাহলে ঠাকুর আবদ্ধ হয়েছেন?
অন্নদা-দা—ওটা নিষ্ঠার ব্যাপার। প্রয়োজনে যেতে হতে পারে, ওটা আলাদা ব্যাপারের মধ্যে পড়ছে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—কাপড়টার উপর আমার কর্তব্য আছে। যে যতখানি দেয়, আমি ততখানি তার সত্তাকে পোষণও দেব—এইটাই তো নিয়ম। সংকল্প একটা আলাদা জিনিস আর আবদ্ধ অন্য ব্যাপার। যেমন সমিতিতে যার কাজ বেশি ধরে—টাকা বেশি আসে তাকে নেয়। নতুন শেখানোর ইচ্ছাও নাই, নিপুণ করারও ইচ্ছা নাই। তাতে আবদ্ধ হয়ে গেল—সংকল্প থেকে চ্যুতি এল।
অজিতদা (গাঙ্গুলী)—আজ্ঞে, একবার রামকৃষ্ণদেব বলছেন—যার ধ্যান করছে, তার পায়খানা লেগেছে! (আর) সে হয়তো ধ্যানে মগ্ন হয়ে গেল।—এটা কি রকম?
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—লাট্টু মহারাজের ঐ রকম হয়েছিল। তখন ঠাকুর লাথি মেরে বলেন—যার ধ্যান করিস তার হাগা চেপেছে, ধ্যান করছে! ওখানেও ঐ ব্যাপার—গুরুর সন্তোষ লাভ করা। তাঁর তৃপ্তি, প্রীতি লাভ করাই সিদ্ধির পথ। তাহলেই আলুর মত সিদ্ধ হয়ে গেল। তিনি সিদ্ধ বলে দিলেই হয়ে গেল—আর কিছুর প্রয়োজন নাই।
[ পিতৃদেবের চরণপ্রান্তে/তাং-১২/৬/৭৯ ইং ]
“সত্যানুসরণ’-এ ঠাকুর বলেছেন—“কাজ ক’রে যাও, কিন্তু আবদ্ধ হ’য়ো না। যদি বিষয়ের পরিবর্তনে তোমার হৃদয়ে পরিবর্তন আসছে বুঝতে পার, আর সে পরিবর্তন তোমার বাঞ্ছনীয় নয়, তবে ঠিক জেনো তুমি আবদ্ধ হয়েছ।” কথাটার ভাব আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। একদিন সময় সুযোগ দেখে শ্রীশ্রীবড়দার চরণে নিবেদন করলাম। তিনি তৎক্ষণাৎ আমার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন—যাহা চিরকাল আমার অন্তরের মণিকোঠায় সুরক্ষিত থাকবে। ব্যাখ্যাটি ছিল এই রকম—আবদ্ধ না হওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
শ্রীশ্রীবড়দা—”ধর্, তুই ভাল বক্তৃতা করিস। তোর বিষয় হল বক্তৃতা । বক্তৃতাকে তুই উপভোগ করিস্। তোকে বলা হল—আনন্দবাজারে ঝাড়ু দিতে । তোর বিষয়ের পরিবর্তন হল। বক্তৃতা ছিল বিষয়। এখন বিষয় হল আনন্দবাজারে ঝাড়ু দেওয়া। ঝাড়ু দেওয়া বিষয়টা তোর আদৌ ভাল লাগল না। তোর মনে প্রতিক্রিয়া হল। তুই অস্বস্তি বোধ করলি। বিষয়ের পরিবর্তনে তোর হৃদয়ের ভাবের পরিবর্তন হল। এই পরিবর্তন বাঞ্চনীয় নয়। তার মানে তুই বক্তৃতা বিষয়েই আবদ্ধ হয়ে গেছিস।”
[ আলোচনা, শ্রাবণ, ১৪১৭/আগস্ট ২০১০ (পৃ: ৫৬৫)]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ৬৭, ৬৮]