সত্যানুসরণ -এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
“চাওয়াটা না-পাওয়াই দুঃখ। কিছু চেও না। সব অবস্থায় রাজী থাক, দুঃখ তোমার কী ক’রবে?“
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীশ্রীপিতৃদেবের নির্দেশক্রমে শঙ্করদা (রায়) আলোচনা শুরু করলেন—যখন কিছু চাই কিন্তু পাই না তখনই দুঃখ আসে। আমাদের সব অবস্থায় রাজী থাকতে হবে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সব অবস্থায় রাজী থাকলে দুঃখ আসে না।
কিন্তু ধর, ঠাকুরকে রোজ সকালে সাদা ফুল দিই, আজ কাছাকাছি পেলাম না, কিংবা ঠাকুরভোগে একটা ফল দেব ভেবেছি, বাড়িতে নেই; তাই বলে এখানেও কি না-পাওয়ায় রাজী থাকতে হ’বে? যেমন করেই হোক যোগাড় করতে হবে। যেমন ক’রে মানে অসদুপায়ে করলে চলবে না।… . ইষ্টার্থ পরিপূরণের আমার যে চাহিদা তা’ তো সবসময় থাকবেই। ইষ্টার্থ পরিপূরণে চাহিদা যতই উদ্গ্রীব হবে ততই বল, বীর্য, সাহস, বুদ্ধি বেড়ে যাবে।
শঙ্করদা—আমাদের নানারকম চাওয়া থাকে তো।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—চাওয়া তো আছেই। সহস্র রকম চাহিদা রয়েছে। খাচ্ছি চিঁড়ের মোয়া, ভাবছি মুড়ির মোয়া হ’লে ভাল হত। তুমি দিলে তিলের নাড়ু ভাবছি নারকেলের নাড়ু হলে ভাল হ’ত।
জনৈক দাদা—রবিঠাকুরের বলা আছে—
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই
যাহা পাই তাহা চাই না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, ঐ কথাই তো। আমাদের গন্তব্য হ’ল ঈশ্বর লাভ। সেইটাই প্রকৃত চাহিদা। কিন্তু নানা প্রবৃত্তিমার্গী চাহিদার ফাঁদে আসল চাহিদাই হারিয়ে যায়। মন লোভ রিপু দ্বারা আক্রান্ত হয়। গন্তব্য যদি ঠিক না থাকে, Ideal (আদর্শ) যদি ঠিক না থাকে, তাহ’লে আসল চাহিদা হারিয়ে যায়।
ঠাকুর বলেছেন, যে-অবস্থায় আছ সে’ অবস্থায়ই রাজী থাক। তার মানে এই নয় যে আমি এগোবার পথ ধ’রে এগোব না। এগোবার যে পথ সে-পথে যেতেই হয়।
‘সব অবস্থায় রাজী থাকা’—প্রসঙ্গে আবার প্রশ্ন উঠল।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—আমার গেঞ্জি আছে, সোয়েটার নেই। পণ্ডিতের সোয়েটার দেখে আমার সোয়েটার পরার ইচ্ছে হ’ল। কিন্তু এতেই যখন আমার চলে যাচ্ছে—শীত করছে না, ঠাণ্ডা লাগছে না—তখন আমার যা’ আছে তাতেই আমি খুশি থাকব। সব অবস্থায় রাজী থাকার অর্থই হ’ল তাই।
(একটু থেমে) সর্বদা ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার দিকে নজর রাখতে হয়। সে-রকম চাহিদা নিয়ে এগিয়ে চলতে হয়। কিন্তু আত্মস্বার্থী চাহিদাকে প্রশ্রয় দিতে নেই। সব অবস্থায় রাজী থাকা মানে নিষ্কর্মা হ’য়ে ব’সে থাকা নয়। কর্ম তো আছেই। কর্মের মাধ্যমেই আমার প্রাপ্তি হচ্ছে।
অমূল্যদা (রায়)—ইস্টের জন্য কোন জিনিস চাইলাম এক দাদার কাছে। ভেবেছিলাম চাইলেই পাওয়া যাবে। তা’ না পেলেও দুঃখ আসে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তুমি কি সকলের কাছে ভিক্ষে ক’রে-ক’রে সংসার চালাচ্ছ? সংসারের বেলায় উপায় হচ্ছে আর ইষ্টের জন্যে ভিক্ষা করছ? আর তুমি যখন চাইছ তখন তোমার তো জানাই উচিত কেউ দেবে কেউ দেবে না। আর যারা ভিক্ষে ক’রে সংসার চালায় তারাও জেনেই রেখেছে, সবাই না-ও দিতে পারে। ইষ্টার্থে বললেই সবাই যে দিয়ে দেবে এটাও তো ভুল ধারণা । তবে কথা হচ্ছে, সৎভাবে চলতে হবে, সৎভাবে উপায় করতে হবে, আর জীবন-বৃদ্ধির দিকে যেতে হবে।
শঙ্করদা—অনেক সময় ইষ্টকাজের দায়-দায়িত্ব আসে; কিন্তু তা’ পরিপালন ক’রতে গেলে অনেক দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হ’তে হয়।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—দুঃখ আসে মানে? তাহ’লে কি বলতে চাও ইষ্টকাজ করার জন্য দুঃখ পাচ্ছ?— তা’ না। ব্যাপারটা ঠিক তা’ না। দুঃখের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই তো তাঁকে ধরা, তাঁর পথ ধরে চলা। তোমার ওপর কোন দায়িত্ব এল—ধর, তোমাকে ঠাকুরের প্রয়োজনে ১০০০ টাকা সংগ্রহ করতে হচ্ছে; ওটা না হওয়া অবধি তোমার মনে একটা উদ্বেগ, একটা ব্যাকুলতা থাকবেই। এ-রকম উদ্বেগ না থাকলে তো কার্যসিদ্ধিই হয় না। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার আগে বাবার উদ্বেগ থাকে, পরীক্ষায় পাশের আগে result নিয়ে ছাত্রের উদ্বেগ থাকে, ইস্ট-দায়িত্ব পরিপূরণে একটা উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক। তা’তে দুঃখ আসবে কেন? বরং তাঁর ইচ্ছা পরিপূরণে আসবে শান্তি—তৃপ্তি—আনন্দ।
অমৃল্যদা—কিছু দিতে ইচ্ছা হ’ল, কিন্তু সামৰ্থ্যে কুলাল না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ইচ্ছা হ’ল তো দেবে। দেবার ইচ্ছা প্রবল হ’লে করার ইচ্ছাও প্রবল হ’বে। সামর্থ্যও বেড়ে যাবে। সব অবস্থায় রাজী থাকা মানে তো নিষ্কর্মা হ’য়ে বসে থাকা না। তোমার হয়তো পণ্ডিতমশাইকে একখানা কাপড় দিতে ইচ্ছা হ’ল। দেবে। আজ না হয় কাল দেবে।
প্রশ্ন—অনেক সময় ছেলে-মেয়ে নিয়ে যাদের সংসার, তাদের বাড়িতে একটা-না-একটা ঝামেলা লেগেই থাকে। এ-অবস্থায় কী করণীয়?
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—এ-জন্যই তো ঠাকুর ঐ বাণী দিয়েছেন।
এমন অনেক বাড়ি আছে স্বামী-স্ত্রী আর দুতিনটে ছেলে-মেয়ে; কিন্তু আর্থিক অনটন। তবু যা’ আছে তা’ নিয়েই খুশি। আবার কোন বাড়িতে হয়তো মা আর ছেলে। কিন্তু অশান্তি লেগেই থাকে। মা হয়তো তিন তরকারি রান্না করেছে। ছেলে বলল, ‘ঝোল রাঁধনি কেন? এই দিয়েই কি খাওয়া যায়?’ থালা-ঘটি-বাটি ছুঁড়ে চিৎকার করতে-করতে উঠে গেল। হৈ-চৈ—পাড়াশুদ্ধ সাড়া পড়ে গেল।
আবার অনেক বাড়ি এমন—মা যা’ রেঁধেছে তাতেই খুশি। সবাই মসুরের ডাল দিয়ে হাসিমুখে খাচ্ছে। কিংবা হয়তো বাড়িতে বেগুন ফলেছে, বেগুন ভাজা চলছে। রোজ বেগুন-ভাজা দিয়েই ভাত খাচ্ছে। কারো মুখে কোন প্রতিবাদ নেই। মা’র হাতের জিনিস—যা’ পায় তাই অমৃত। বাইরে গিয়েও তারা যা’ পায় তাতেই খুশি। সেজন্য সকলের প্রিয়পাত্রও হয়। কোন ভাই এম- এ পাশ করেছে, কোন ভাই ডাক্তার, কোন ভাই ইঞ্জিনীয়ার—কিন্ত কাউকে দেখে এসব বোঝার উপায় নেই। বাড়ির কর্তাও বাড়ির ছেলেপিলে নিয়ে শান্তিতে বাস করে।
কিন্তু ঐ যে-বাড়িতে সব অবস্থায় রাজী থাকে না, সবসময় একটা-না-একটা না পাওয়ার জন্য দুঃখ —সেখানে ছেলেরা হয়তো বড় হ’য়েছে, চাকরিও পেয়েছে কিন্তু মনে অশান্তি আছেই। টাকা থাকা সত্ত্বেও এ-ওকে বিশ্বাস করে না। ভাই-ভাইতে মিল নেই। ঘর-সংসার ক’রেও শান্তি নেই।
কোন কোন সংসারের ক্ষেত্রে যেমন দেখি, মা-বাবার ওপর নির্ভর ক’রে চললে সন্তানদের কোন চাহিদাই থাকে না, তারা জানে যা’ করলে আমাদের মঙ্গল হবে মা-বাবা তাই করে চলেছেন,—এই নির্ভরতার জন্য তারা শান্তিতে কাটায়। বিশ্বসংসারের দিকে তাকালেও ঐ একই ব্যাপার দেখা যায়।
পরমপিতার ওপর নির্ভর ক’রে থাকলে নিজস্ব কোন চাহিদা থাকে না। তখন মনে হয় তিনি মঙ্গলময়, তিনি আমার জীবন-বৃদ্ধির উৎস। তাই তিনি যে অবস্থায় রাখেন তাতেই মঙ্গল। পরমপিতার ওপর বিশ্বাস রেখে তাঁর পথে নিষ্ঠা, আনুগত্য, কৃতিসম্বেগ নিয়ে চললে সাংসারিক কোন চাহিদাই কখনও পীড়িত করতে পারে না। ইষ্টের সম্তোষসাধনই তখন তার একমাত্র চাহিদা হয়। ইষ্টের সন্তোষসাধনই যাদের একমাত্র চাহিদা, তাঁর স্বার্থ পরিপূরণেই যারা উদ্গ্রীব, তারা চির-শান্তির অধিকারী হয়।
[ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং২৫/১১/৭৫ ইং]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ১৯, ২০, ২১]