সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
“তুমি সত্যে অবস্থান কর, অন্যায়কে সহ্য ক’রতে চেষ্টা কর, প্রতিরোধ ক’রো না, শীঘ্রই পরম মঙ্গলের অধিকারী হবে।“
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—স্বস্তিরানী, আলোচনা কর।
স্বস্তিরানী—’সত্য’ এসেছে ‘অস্” ধাতু থেকে। অস্ মানে অস্তিত্ব, বিদ্যমানতা। এখানে সত্যে অবস্থান করার কথা বলা হচ্ছে মানে ইষ্টকে ধ’রে রাখার কথা বলা হচ্ছে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তা’ কেমন ক’রে? বুঝিয়ে বলতে হবে তো!
স্বস্তিরানী কিছু বলছে না দেখে তিনি বললেন— বল্ যিনি অস্তিত্বের মূর্ত প্রতীক—যাঁকে অবলম্বন ক’রে চললে অস্তিত্ব বজায় থাকে, বিদ্যমানতা বজায় থাকে, তিনি ইষ্ট। সত্যে অবস্থান করা মানে তাঁতে লেগে থাকা।
হরিপদদা—অস্ + শতৃ = সৎ। অস্ মানে অস্তিত্ব বা বিদ্যমানতা। এই অস্তিত্ব বা বিদ্যমানতার মূর্ত্ত প্রতীক হলেন ইস্ট। তাই তিনিই সত্য। তাঁকে অবলম্বন ক’রে চলার কথা হচ্ছে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ। সত্য মানে যার অস্তিত্ব আছে, বিদ্যমানতা আছে। যা সত্য নয় সে-সবই মিথ্যা, ক্ষণস্থায়ী।—কেউ দু’মিনিট, কেউ দু’ঘন্টা বা দু’বছর স্থায়ী হয়।
অস্তিত্বের মূর্ত্ত প্রতীক হলেন ইষ্ট। তাই তাঁকে (ইষ্ট) আশ্রয় ক’রে চলাই, তাঁকে খুশি ক’রে চলাই সত্যে অবস্থান করা। এখানে সত্য মানে সৎ-এর ভাব। মানুষ যখন ইষ্টকে সর্বান্তঃকরণে মাথায় নিয়ে চলে তখনই তার মধ্যে ঐ ভাব জেগে ওঠে।
‘অন্যায়কে সহ্য ক’রতে চেষ্টা কর’—মানে কী? ঠাকুর বাণী দিয়েছেন কার জন্য? আমার জন্য তো! তাই কেউ আমার সাথে অন্যায় আচরণ করলে সহ্য করতে হবে। ধর, তুমি আমাকে খামাখা মারলে, দু’কথা শোনালে—তখন সহ্য করতে হবে। ‘প্রতিরোধ ক’রো না’—অর্থাৎ এখানে প্রতিরোধ না করার কথা বলা হচ্ছে, সহ্য ক’রে থাকার কথাই বলা হচ্ছে। কথায় আছে, যে সয় সে রয়। সহ্য করতে পারলে তখন আমার ক্ষমতা (সহ্যক্ষমতা) বেড়ে যাবে। কিন্তু আমার সামনে কেউ যদি আমার গুরুজনদের বা বন্ধুবান্ধবদের প্রতি অন্যায় করে তখন রুখে দাঁড়াব। এমনকি জীবজন্তুদের প্রতি কেউ অন্যায় আচরণ করলে রুখে দাঁড়াতে হয়, তখন প্রতিরোধ করতে হয়। তখন প্রতিরোধ করাটাই পৌরুষের। আর তা না করা ক্লীবত্ব—তাই তা পাপের।
অবশ্য দেখতে হবে কেমনভাবে প্রতিরোধ করা যায়। যেমন করলে সেই প্রতিরোধ সুন্দর হয় সেরূপ করতে হবে। অনর্থক গোল পাকিয়ে লাভ নেই। অনেকে অন্যায় করে বোধের অভাবে। হয়তো কলের জল খেয়ে কলের মুখ বন্ধ করল না, তখন প্রতিরোধ করতে হবে। হয়তো জামাটা উল্টোদিকে পরেছে—তখন তা দেখিয়ে দিতে হয়। এটা কোন দোষের নয়, বরং তা না করাই দোষের।
কিন্তু যদি আমাকে গালি দিয়ে কাপড় ছিঁড়ে দিয়ে যায় তখন তার সবটুকুই সহ্য করতে হবে। ঠাকুর বলছেন—শীঘ্রই মঙ্গলের অধিকারী হবে। অর্থাৎ ঐ সহ্য করাতেই আমার মঙ্গল নিহিত।
[ ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তারিখ-১৩/৬/৭৭ ইং ]
স্নেহলতা কর বাণীটি আলোচনার নির্দেশ পেয়ে পুনরায় পাঠ করে বললেন—সত্যে অবস্থান করা মানে সৎ পথে থাকা। আর ইষ্টই হচ্ছেন সৎ ও কল্যাণের মূর্ত্ত প্রতীক। তাঁকে মেনে চললেই সৎ পথে থাকা হয়। এই সৎ পথে চলতে যদি কেউ অন্যায় করে—
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—অন্যায়কে কি করতে হবে?
ঠাকুর বলছেন—অন্যায়কে সহ্য কর, প্রতিরোধ করো না, শীঘ্রই পরম মঙ্গলের অধিকারী হবে। —আমার উপর যদি কেউ অন্যায় করে, আমি তা সহ্য করতে চেষ্টা করব, কারণ আমি তো অন্যায় করছি না।
হরিপদদা (দাস)—তাহলে রবি ঠাকুরের কথা আছে—“অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে / তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে।”—এটাতে আর এ বাণীতে মিল হচ্ছে না।
স্নেহলতা’মা—ঠাকুর বলছেন—সত্যে অবস্থান কর, আমি যদি সত্যে অবস্থান করি—
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সত্য মানে কি? —সৎ এসেছে অস্ ধাতু থেকে। মানে অস্তিবৃদ্ধি। সবাই তো সৎ পথে, অস্তিবৃদ্ধির পথে চলে।
হরিপদদা—সৎ পথে চলতে গিয়েও তো আমরা কখনও কখনও অন্যায় করে ফেলি।
স্নেহলতা’মা—আমি যদি সত্যে অবস্থান করি—
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—এখানে ‘যদি’-র কথা নাই। আমাকে সত্যে অবস্থান করতে বলছেন। যিনি জীবনবৃদ্ধির প্রতীক তাঁকে জীবনের ধ্রুবতারা করে, মুখ্য করে চলতে বলছেন। আর বলছেন, অন্যায়কে সহ্য করতে চেষ্টা কর, প্রতিরোধ করো না।
হরিপদদা—রবি ঠাকুরের ঐ কথার সাথে মিল খাচ্ছে না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ঠাকুর ‘আমাকে’ সহ্য করতে বলছেন। ‘আমাদের’ কথার দরকার কি? বাণী তো আমার জন্য ঠাকুর বলছেন। রবি ঠাকুর ঐ রকম বলেছেন, ঠাকুর এই রকম বলেছেন। তাহলে তার কি করা হবে ব্যবস্থা! এটার মধ্যে মিল আছে নাকি?
—ঠাকুর কাকে বলছেন?
—আমাকে বলছেন।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—আমাকে সত্যে অবস্থান করতে বলছেন, তারপর অন্যায়কে সহ্য করতে বলছেন। স্নেহলতা’মা—আমার প্রতি যদি কেউ অন্যায় করে সহ্য করব, যদি আমি সত্যে অবস্থান করি।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—’যদি’-র কথা নাই। আমি সত্যে অবস্থান করবই। তখন কেউ যদি আমার প্রতি অন্যায় করে আমি তা সহ্য করব কিন্তু অন্যের প্রতি অন্যায় করলে রুখে দাঁড়াব। রবি ঠাকুরও এ কথাই বলেছেন। আমার সামনে যদি কেউ অন্যায় করে কারো প্রতি, তখন সহ্য করা চলবে না। এটা মনে রাখতে হবে সব সময়। আর একটা চলতি কথা আছে না, ঘরোয়া কথা?—“যে সয় সে রয়”।
স্নেহলতা’মা—আজ্ঞে।
[পিতৃদেবের চরণপ্রান্তে/ তারিখ-৩০/৯/৭৯ ইং]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা১৬৪-১৬৬]