দিয়ে দাও, ….হ’য়ে যাচ্ছে। – ব্যাখ্যা

সত্যানুসরণ -এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:

দিয়ে দাও, নিজের জন্য কিছু চেও না; দেখবে সব তোমার হ’য়ে যাচ্ছে।

পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :

প্রশ্ন তুললেন সতীশদা (পাল)—দিয়ে দিলে তো কমে যাবে, সব হয়ে যাবে কেমন করে?

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—খুব সাংঘাতিক কথা! দিয়ে দিলে সব হয়ে যাবে কেমন করে? তুই যদি চশমা, চাদর সব দিয়ে দিস, কেমন করে তোর হয়ে যাবে? লোকে তো জানে দিয়ে দিতে দিতে ফকির হয়ে যেতে হবে। কে বলবে?

অসীম ভট্রাচার্য—আমি বলব?

শ্রীশ্রীপিতৃদেব— হ্যাঁ-হ্যাঁ, বল।

সতীশদাকে লক্ষ্য করে অসীমদা বললেন—আপনার টাকার প্রয়োজন হয়েছে। আমার কাছে দুটো টাকা রয়েছে। একটা টাকা আমি আপনাকে দিলাম।

প্রফুল্ল (বক্সী) পাশেই রয়েছেন। বয়স্ক লোক। বললেন—দুটো টাকাই দিলাম না কেন? প্রফুল্পদার কথা শুনে সকলেই হেসে উঠলেন।

অসীমদা—কিছু রেখে কিছু দিতে হয়।

প্রফুল্লদা—সব তোমার হয়ে যাচ্ছে কেমন ক’রে?

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—অসীমের কথা অনুযায়ী তার অর্ধেক হয়ে যাবে নাকি?

অসীমদা—আমি যখন কাউকে দিচ্ছি, যতটা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব ততটা দেব। আমারও তো প্রয়োজন। আমারও স্বার্থ দেখতে হবে। যাতে অসুবিধায় না পড়ি।

অসীমদার আলোচনায় বাণীর অর্থ পরিস্ফুট হ’চ্ছে না দেখে শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—দিলে তো অসুবিধা হতেই পারে, অন্যের প্রয়োজনটা বেশি করে দেখছি বলেই তো দিতে পারছি। নিঃস্বার্থভাবে দিলেই মনের জোর থাকে। অন্যের প্রয়োজনটাই বড়। যে সদাশয় ব্যক্তি, যে উদার, সে নিঃস্বার্থভাবেই অন্যের জন্য করে, অন্যকে দেয়। মানুষ আপন টাকা পর—এইভাব নিয়ে যে দেয়, ফলও সে ততখানি পায়। এমন হতে পারে, কারও হয়তো তখনই টাকার দরকার, জরুরি কাজে। কিন্তু নিজের জন্য সে কিছু করে না, অপরের জন্যই করে থাকে। বিশ্বাস, নির্ভরতা থাকলে তারও উপায় হয়ই। মহাসাধক বামাক্ষ্যাপা শ্মশানে থাকেন। তাঁর মাতৃদেবীর শ্রাদ্ধকার্যের সময় ভারে-ভারে নানাস্থান থেকে জিনিসপত্রাদি আসতে লাগল। বামাক্ষ্যাপা শুধু তো মা-মা করেন। মায়ের উপর নির্ভরতা ছিল। মায়ের দয়ায় যা হবার হবে। শ্রাদ্ধের দিন আকাশে মেঘ উঠল। বৃষ্টি শুরু হ’ল। বামাক্ষ্যাপা প্রার্থনা জানালেন মায়ের শ্রীচরণে যাতে শ্রাদ্ধ ও আহারাদির স্থানে বৃষ্টি না পড়ে। মা সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। নির্বিঘ্নে কাজ সম্পন্ন হ’ল। দম্ভ, দর্প, অভিমান যাঁর নাই, আমার-আমার বোধ নাই তাঁর কাছে মায়েরই এই দুনিয়া, সবাই আপন।—এরকম বহু উদাহরণ আছে।

নিত্যানন্দদা (মণ্ডল)—দিয়ে দেওয়াটা কি একখানে?

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—একখানে কী? তিনি তো সব জায়গায় আছেন। “You are for the Lord/Not for others/You are for the Lord/And so for others.” সাধনা করতে-করতে দেখা যায় সবই তো তাঁর। তখন কাউকে না খেতে দেখলে নিজেকে অভুক্ত মনে হয়। কেউ অসুবিধায় পড়লে নিজেরই অসুবিধা বোধ করব। যে আমি ক্ষুদ্র ছিলাম তা বৃহৎ হয়ে পড়ে। আমির ব্যাপ্তি বেড়ে যায়। ননীদা (চক্রবর্তী) হয়তো বাজারে যাচ্ছেন ডাক্তারের প্রেসক্রিপসন নিয়ে। ছেলের অসুখ। দুটো টাকা সঙ্গে আছে। পথে কারো ছেলেপিলেরা অন্নাভাবে অভুক্ত আছে শুনে পকেটের টাকা দুটো তার হাতে দিয়ে দিলেন। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে খালি হাতেই বাজারে গেলেন। দোকানদারকে বললেন— আগামীকাল ওষুধের দামটা দিয়ে দেব। দোকানদার রাজীও হয়ে গেল। যারা নিঃস্বার্থভাবে অপরের জন্য করে তাদের উপায়ও হয়ে যায়। আর যারা ভাগজোখ ক’রে করে, তাদের ততটুকুই হয়। যখন যোলআনা মন দিয়ে করি তখন ফলও যোলআনা। কেউ ভাবতে পারে আমার হাতে তো মাত্র দুটাকা আছে, এটা দিয়ে দিলে ওষুধ আনা যাবে না, তাই দিলাম না। কেউ হয়ত ভাবল, ১টাকা দিই, আবার ননীদার মত লোক দু’টাকাই দিয়ে দেবে। ফল বা ক্রিয়াও তাই বিভিন্ন ব্যক্তির উপর বিভিন্ন রকমের। যে সব দিয়ে দিচ্ছে তার নির্ভরতা বেড়ে যায়, সে scope পায় পরমপিতার দয়া উপলব্ধি করার। হয়ত বাজারে কারও সাথে যোগাযোগ হয়ে গেল, সে-ই ওষুধের দামের ব্যবস্থা করে দিল—এগুলোই পরমপিতার দয়া। কোন কাজই তার আটকায় না। আমরা তো হামেশাই দেখি, মা না খেয়ে ছেলেকে খাওয়ায়। ছেলেকে খাওয়ানোতেই মায়ের তৃপ্তি, মায়ের খাওয়া হয়ে যায়। (একটু থেমে) কে সিকি দিল, কে আধুলি দিল এটা বড় কথা না, কে কতখানি হৃদয় উজাড় করে দিল, কতখানি মনপ্রাণ দিয়ে দিল এটাই দেখতে হবে।

[ ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-৫/১/৭৬ ইং ]

শ্রীশ্রীপিতৃদেব ছেলেদের মধ্যে জ্ঞানপ্রসাদ উপাধ্যায়কে আলোচনা করার জন্য বললেন।

সে পুনরায় বাণীটি পাঠ করে বলল—এখানে ঠাকুর বলছেন, আমি যদি পাওয়ার আশা না-রেখে কাউকে দান করি—তাহলে দেখব যে সব আমার হয়ে যাচ্ছে।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—পাওয়ার আশা না-রেখে দান করে যাচ্ছ, তাতে সব তোমার হয়ে যাবে কেমন করে?

জ্ঞানপ্রসাদ নিরুত্তর থাকে। তাই বললেনসুভাশিষ (চ্যাটার্জী) বল্‌।

সুভাশিষ—আমি যদি কাউকে নিঃস্বার্থভাবে দান করি, সবাই আমার দানে সন্তুষ্ট হয়ে আমার আয়ত্তে চলে আসবে। আয়ত্তে আসবে মানে আমার হয়ে যাবে।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সে তো ঠিক। কেমন করে আসবে?

শ্রীশ্রীপিতৃদেব নিজেই বলে দিলেন—নিঃস্বার্থ হয়ে দাও। স্বার্থ না-রেখে, যখন যা কর নিঃস্বার্থ হয়ে কর। তা কথা দিয়েই হোক, দান দিয়েই হোক। তুমি যদি আমাকে ভালবাস, আমি যদি তোমাকে ভালবাসি—তোমার যদি কোন অসুবিধা হয়—আমি খবর নেব কেমন করে অসুবিধা দূর করা যায়। আর মানুষ আমার হয়ে গেলে সব হয়ে যায়।—তাই বলছিস্‌ তো?

সুভাশিষ—আজ্ঞে।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব সুভাশিষের দিকে তাকিয়ে খুশি ভরে বললেন—ঠিক বলেছিস।

[ পিতৃদেবের চরণপ্রান্তে/তাং-৯/৬/৭৯ ইং ]

[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ৬৩, ৬৪, ৬৫]