সত্যানুসরণ -এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
“দুঃখও একরকম ভাব, সুখও একরকম ভাব। অভাবের বা চাওয়ার ভাবটাই দুঃখ। তুমি জগতের হাজার করেও দুঃখ নষ্ট ক’রতে পারবে না—যতক্ষণ তুমি হৃদয় থেকে ঐ অভাবের ভাবটা কেড়ে না নিচ্ছ। আর, ধর্ম্মই তা’ ক’রতে পারে।“
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—আলোচনা কর্।
গুরুকিংকরদা—গতকাল মুরারিদা (দাঁ) বলছিলেন—তুমি আমার কাছে একশ টাকা চাইলে, পেলে না; দুঃখ পেলে। আমি তোমার দুঃখের কারণ হ’য়ে থাকলাম। তা-না। চাওয়াটাই দুঃখের কারণ।
সতীশদা কিছু বললেন। কিন্তু বিষয়টি পরিস্কার হ’ল না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—কেউ যদি অকপটভাবে ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠাপন্ন হয়ে চলে, ইষ্টকে জীবনে মুখ্য করে তখনই তার কোন চাহিদা থাকে না। ‘যদ্ লাভং পরমলাভম্’। অন্যদিকে মন নাই। তখন প্রয়োজনের উপকরণ পরমপিতার দয়ায় কাছে এসে পড়ে। কোন অভাববোধ থাকে না।
সাধারণভাবে পরমপিতার দয়ার উপর আমরা অনেকে নির্ভর করি না। যখন সংকটময় মুহূর্ত আসে তখন তিনি ছাড়া কেউ নেই। যেমন, নৌকা-ডুবি হচ্ছে, হিন্দু-মুসলমান যত আছে সবাই তখন ঈশ্বরমুখী হয়ে পড়ে । আর অন্যদিকে মন থাকে না। সংকটকাল কেটে গেলে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে।
কিন্তু ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠা যার জীবনের ব্রত, ইষ্টকে খুশি করাই যার জীবনের একমাত্র চাহিদা জীবনের প্রতি পদক্ষেপে সে ইষ্টের দয়া অনুভব করে থাকে।
প্ৰসঙ্গক্ৰমে শ্রীশ্রীপিতৃদেব পাবনা আশ্রমের এক ঘটনা উল্লেখ করলেন।—আশ্রমের তখন অসচ্ছল অবস্থা। বহু লোক সেদিন আশ্রমে এসেছে। ঠাকুমা দেখলেন এত লোকের আহারের জন্য ভাত যে রান্না হবে চাল তো নেই। ঠাকুমা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। অগত্যা ঠাকুরকে জানালেন। ঠাকুর বললেন—উনুনে জল চাপিয়ে দে, এখনই চাল এসে পড়বে। ঠাকুরের ইচ্ছামত ঠাকুমা উনুনে জল চাপিয়ে দিতেই পদ্মাঘাটে একটা নৌকা কয়েকজন যাত্রী নিয়ে এসে ভিড়ল। তাদের সাথে চালের বস্তা। যত চাল আছে সবই ঠাকুমাকে দিয়ে দিল। বলল, পয়সার জন্য ভাববেন না, পরে যখন ইচ্ছা দাম দেবেন। ঠাকুরের দয়াতেই এরূপ হয়। এখানে যে এতলোক আছি আমাদের কি জমিদারী আছে? ঠাকুরের দয়ায় চলে যাচ্ছে। কারও নূতন স্যাণ্ডেল দেখে মনে হল ছেঁড়া চটি পরে আছি। এভাবে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ি এবং দুঃখে মগ্ন হই। আবার ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার কাজে যুক্ত থেকে ইষ্টচিন্তা করতে-করতে মন ওপরে ওঠে। এইভাবে ওঠানামা করতে করতে যখন constant তাঁকে ধরতে পারি তখনই তাঁ কে পাওয়া যায়। তখন কোন অভাবই আমাকে স্পর্শ করে না। ইষ্টকে নিয়ে মশগুল থাকলে বিত্তসম্পদ পায়ের কাছ দিয়ে গেলেও তা পাবার বাসনা হবে না।
[ ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-২৯/১১/৭৫ ইং]
নিত্যানন্দদা—’ধর্ম্মই তা ক’রতে পারে’—কেমন ক’রে?
শ্রীশ্রীবড়দা—কেমন ক’রে বল?
নিত্যানন্দদা—ধর্ম্ম মূর্ত হয় আদর্শে—করার ভেতর দিয়ে।
শ্রীশ্রীবড়দা—দুর্গেশ বল।
দুর্গেশদা—যে চাওয়ার ভেতর দিয়ে মানুষ দুঃখ পায়, তা হ’লো তার প্রকৃতিগত চাওয়া—আর ধৰ্ম্ম হ’লো বাঁচাবাড়া।
কুষ্টিয়ার এক দাদা— ইষ্টের ভেতর প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ আছে, তাঁকে ধ’রে ঐ প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত হয়।
শ্রীশ্রীবড়দা—(নিত্যানন্দদাকে) দুঃখের ভাব চলে গেল কেমন ক’রে? করার ভেতর দিয়ে। আদর্শের প্রতি অনুরাগ থেকে আদর্শের তৃপ্তির জন্য সে করে, বৃত্তি নিয়ন্ত্রণের জন্য সে করে না। আদর্শের চিন্তাতেই তার হৃদয়-মন জুড়ে থাকে; সে বৃত্তি-নিয়ন্ত্রণের ধার ধারে না।
শরৎদা—সুখ আর আনন্দ কি?
ননীদা—একজনের মাইনে ২৫ টাকা বাড়ল—সুখ হ’লো, শেষে আর একজনের ৫০ টাকা বাড়ল—তখন, দুঃখ হ’লো।
শ্রীশ্রীবড়দা—আসল হ’লো সৎ-চিৎ-আনন্দ। দুঃখেও চোখ দিয়ে জল এল, আবার আনন্দেও চোখ দিয়ে জল এল। ঠাকুর এতদিন ধ’রে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন ইষ্টভৃতি অফিসে পাঠাতে, শেষে কার পাল্লায় প’ড়ে অন্য জায়গায় পাঠাতে লাগলাম। যার ভেতর ইষ্ট নেই, তাঁর স্পর্শ নেই, তাঁর কর্ম্ম নেই, তার কাছে তা কিছুই বলে মনে হয় না। সচ্চিদানন্দময় হ’লে তখন সংসার ও জঙ্গল এক। (নিত্যানন্দদাকে) বুঝলি না কি?
একমাত্র “ধর্ম্মই তা’ ক’রতে পারে।” ইষ্টসেবায় মন লেগে গেল। যেটা আমি উপভোগ করতে চাই, তাই তো ধর্ম্ম।
[‘যামিনীকান্তরায়চৌধুরীর দিনলিপি/তাং-২০/৭/৭১ ইং ]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ২৬, ২৭]