সত্যানুসরণ -এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
“দুঃখ কারো প্রকৃতিগত নয়কো, তা’কে ইচ্ছে ক’রলেই তাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।“
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীপিতৃদেবের নির্দেশে হরিপদদা (দাস) বলতে শুরু করলেন—দুঃখ কেউ নিয়ে আসে না। সব মানুষই সমান। দুঃখ মানুষের সৃষ্টি।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সবাই সমান কি করে? কেউ হয়তো জন্মগ্রহণ ক’রে একফোঁটা মধু পায় না, আবার কেউ মুখে golden spoon (সোনার চামচ) নিয়েই জন্মায়—এ-রকম তো হামেশা দেখা যায়। পরিবেশের তো একটা influence (প্রভাব) থাকবেই।
গুরুকিংকরদা—যখন শিশু থাকে তখন সুখ-দুঃখ কিছুই অনুভব করতে পারে না। শিশুর কাছে সুখ-দুঃখ সবই তো সমান।
শ্ৰীশ্রীপিতৃদেব—শিশুও পিঁপড়ে কামড়ালে, মশায় কামড়ালে কাঁদে—এটা যে প্রকৃতিগত নয় ধরে নেব কি করে? Example (উদাহরণ) দিয়ে বিচার করবি তো।
হরিপদদা—তাহ’লে মানুষের উপর পরিবেশের প্রভাব থাকায় তা’ হচ্ছে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—এমন মায়ের গর্ভে জন্মালো যেজন্য তার ঐ অবস্থা। এখানে প্রারব্ধ আছে বলতে হয়। জন্মান্তরে আমরা বিশ্বাস করি তো?
হরিপদদা—আজ্ঞে করি।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—জন্মান্তরে বিশ্বাস করিস্, ঠাকুরের বাণীও স্বীকার করিস্—দুটো মিল করে দে, আলোচনা ক’রে বুঝিয়ে দে।
আগে প্রমাণ কর—দুঃখ প্রকৃতিগত নয়, তারপর বলবি ইচ্ছা করলেই তাড়িয়ে দেওয়া যায়।
হরিপদদা—আজ্ঞে, কিছু চাইতে গিয়েই দুঃখ আসে। দুঃখ চাওয়ার জন্যই । জন্মাবার সঙ্গে-সঙ্গেই চাওয়া আসে না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—পৃথিবীতে আসতে-আসতেই চাওয়া আসে না ঠিকই কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি রয়েছে। দুঃখ যে প্রকৃতিগত নয় এটাই প্রমাণ করতে হবে।
পূর্বোক্ত উদাহরণ ধরে বললেন—ওই দুটি ছেলের ক্ষেত্রে প্রথম ছেলেটিকে দ্বিতীয় ছেলের স্থানে এনে ফেললে কাঁদবে না। দ্বিতীয় ছেলেকে প্রথম ছেলের স্থানে আনলে কাঁদবে। যতদিন না মন তৈরি হচ্ছে ততদিন এটা হবে। বাল্যকাল দেখলেই বোঝা যাবে, দুঃখ কারো প্রকৃতিগত নয় । এ-ও মাটি খায়, ও-ও মাটি খায়। আলো দেখলে এ-ও হাত দিতে যায়, ও-ও হাত দিতে যায়, এ-ও গু মাখামাখি করে, ও-ও করে।
আর মন তৈরি হ’লে পর একজন ছেলে হয়তো ভাল মাখন পেয়ে বলছে অস্ট্রেলিয়ার মাখন নিয়ে এস। আর একজন হয়তো মুড়ি খাচ্ছে শুধু বাতাসা দিয়ে, সে মাকে বলছে এত ভাল খাবার আছে না-কি!
তোমার কাশ্মীরী শাল আছে, আমার নেই; আমার লোভ হ’ল, মনে কাশ্মীরী শালের আকাঙ্ক্ষা হ’ল, আবার তা না পেলেই দুঃখ হ’ল।
হরিপদদা—আজ্ঞে, অনেককে পেটের ভাত জুটানোর জন্য হাড়ভাঙ্গা খাটতে হয়।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—কর্ম আছে বলেই জীবন আছে। শোন্ তবে একটা ঘটনা বলি।
এক ভদ্রলোক—বয়স ৭০-৭৫, বেশ active (কর্মঠ), রোজ সকালে প্রাতঃকৃত্য সেরে morning walk (প্রাতঃভ্রমণ) করে। তারপর যা’ পায় খায়; না পেলে না খেয়েই বাজারে বেরিয়ে যায়। তারপর বাজার সেরে সঙ্গী সাথীদের সাথে দেখা ক’রে বাড়ি ফেরে ১০টায়। তারপর খেয়েটেয়ে বিশ্রাম ক’রে বিকেলে আবার বেরিয়ে পড়ে । এমনি ক’রে সারাটা দিনই কাজ-কর্মের মধ্যে থাকে।
এ ভদ্রলোকের মেয়ে-জামাইয়ের খুব টান তার (বৃদ্ধের) ওপর। তাকে তারা ময়ূরভঞ্জে নিয়ে গেল। কোন কাজ করতে যাবে, তারা করতে দেয় না, ২৪ ঘন্টা বসিয়ে রেখে দেয়, আদর-যত্ন করে। সেবা দেয়। এমনি ক’রে ক’রেই কিন্তু তাকে রোগে ধরল। সারানো গেল না। পরে মারাও গেল এ অসুখেই।
একটু থেমে পুনরায় বলে চলেছেন—যারা কোনো অবস্থায়ই মনে করে না তোমার আছে আমার নেই, পরমপিতা তাদের শান্তি দেন। দম্ভ-দর্প-অভিমান যার যত সে তত দুঃখ পায়। তার যা’ আছে তাই তার দুঃখের কারণ হ’য়ে দাড়ায় । আমার মাফলার আছে, মা-কে বললাম—আমায় মাংকি ক্যাপ কিনে দাও। মা বলছে—কেন বাবা, তোমার তো মাফলার রয়েছে, মাংকি ক্যাপ কিনে মিছেমিছি পয়সা খরচ কেন? ব্যাস, অশান্তি!
আবার, শোক-দুঃখ বিপদ-আপদ অনেক সময় প্রয়োজন হ’য়ে পড়ে। পরমপিতার ইচ্ছা হ’লে তা-ও ভাল।
“তুমি যদি বোঝ ভাল
যত পার দুঃখ ঢাল
ব্যথার পরশে ভ’রে দিয়ে হিয়া
আমারেই ভালবাসিও।”
প্রকৃত ভক্ত যে—ব্যথা তাকে বিচলিত তো করে না—বরং আনন্দিতই ক’রে তোলে। ব্যথার মধ্যেও সে অনুভব করে তার প্রিয়তমের মঙ্গলেচ্ছা। অনুরাগী ভক্তই বলতে পারে
“দুঃখ ব্যথা সবই প্রভু তোমারই যে দান
তাইতে বুঝি তাদের চুমোয় অবশ করে প্রাণ।”
[ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-২৬/১১/৭৫ ইং]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ২১, ২২, ২৩]