পতিতকে উদ্ধারের … না।-ব্যাখ্যা

সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:

পতিতকে উদ্ধারের কথা শুনাও, আশা দাও, ছলে-বলে-কৌশলে তার উন্নয়নে সাহায্য কর, সাহস দাও—কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল হ’তে দিও না।

পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :

নীরদদা (সরকার) বললেন—জীবন-বৃদ্ধির পথ যারা পায়নি তারাই পতিত।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—জীবন-বৃদ্ধির পথ যে অবলম্বন করে না সে পতিত; ঠিক আছে না কি? পতিত হ’তে গেলে কোন-কিছু হ’তে প’ড়তে হবে তো? জীবন-বৃদ্ধির পথ অবলম্বন না করলে জীবন-বৃদ্ধির পথ ছাড়তে পারে কি?

বাণীর শেষ অংশে ‘উচ্ছৃঙ্খল হ’তে দিও না’ আছে। তাই প্রশ্ন উঠল—উচ্ছৃঙ্খল হ’তে দিও না কিরকম?

প্রফুল্লদা (বক্সী)—একজন লোক হয়তো জলে ডুবে যাচ্ছে, তখন তাকে সাহস দিতে হবে, যাতে উচ্ছৃঙ্খল না হয় তার চেষ্টা করতে হবে।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—যখন জলে ডুবে যাচ্ছে তখন উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার কোন chance (সম্ভাবনা) আছে নাকি? সাহস দিয়ে কি লাভ? সে তো ডুবে যাবে। ওসব চিন্তা nervousness থেকে আসে।

প্রফুল্লদা—আমার যদি তেমন সামর্থ্য থাকে তাহলেই যে ডুবে যাচ্ছে তাকে টেনে তুলতে পারি, নাহলে আমাকেও টেনে ডুবাবে। সে-ক্ষেত্রে তো আমার করণীয় কিছু নাই।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—যারা নির্ভীক তারা ওরকম ভাবে না। তারা যদি দেখে টেনে তুলতে পারি, তাহলে ঝাপিয়ে পড়ে। যদি দেখে তা পারা যাবে না, পরনের কাপড়টা ছুঁড়ে দিয়ে তোলে; তা-ও না হলে চিৎকার ক’রে জানাজানি করে দেয়।

দুর্বল লোকে কিরকম আচরণ করে সে-প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—অনেক লোক আছে, দেখা যায় একে বকছে তাকে বকছে, কোনসময় ছেলেকে দিল এক চড়—এ-সবই weakness (দুর্বলতা) থেকে হয়।

[ ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-১১/৯/৭৫ ইং ]

আদেশক্ৰমে বোধিব্যাস পুনরায় বাণীটি পাঠ ক’রে আলোচনা শুরু করল।

—ঠাকুর বলেছেন, যে পতিত যে পাপী তাকে উদ্ধারের কথা শোনাতে হবে, আশা দিতে হবে। তার উন্নতির জন্য সাহায্য করতে হবে, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল হ’তে দেওয়া চলবে না।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—পতিত মানে কী?

বোধিব্যাস—কেউ যদি পড়ে যায় তবে সে পতিত।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—কোথা থেকে পড়বে? পতিত হ’তে গেলে কিছু থেকে পড়তে হ’বে তো! ঠাকুর কোথা থেকে পড়ার কথা বলছেন? যে জীবনবৃদ্ধির উল্টোপথে গেছে, জীবনবৃদ্ধির পথ থেকে বিচ্যুত, সে পতিত। কেমন ক’রে পতিত হ’ল?—না, জীবনবৃদ্ধির উল্টোপথে চলতে-চলতে তাতে অভ্যস্ত হ’য়ে গেলে সে তখন পতিত হ’য়ে যায়। সমাজের লোক তাকে পতিত ব’লে থাকে। সাধারণতঃ যারা ভ্রুণ-হত্যা, ব্রহ্ম-হত্যা, স্ত্রী-হত্যা, গো-হত্যা ইত্যাদি ক’রে থাকে তারাই পতিত। আগেকার দিনে কোন উৎসব-অনুষ্ঠানে এরকম প্রতিবেশীকে কেউ নেমন্তন্ন করত না। ধোপা বন্ধ, নাপিত বন্ধ—এরকম ব্যবস্থা নেওয়া হ’ত।

“ছলে-বলে-কৌশলে তার উন্নয়নে সাহায্য কর” মানে কী? তার মানে যে পতিত, যে জীবনবৃদ্ধির অপলাপী পথে চ’লে অভ্যস্ত হ’য়ে গেছে, ছলে-বলে-কৌশলে তাকে জীবনবৃদ্ধির পথে নিয়ে আসতে হবে। সে যাতে ইষ্টের পথে আসতে পারে সে- রকম সঙ্গ-সাহচর্য দিতে হবে, সে-রকম কথা শোনাতে হবে। শোনাতে গেলেই কি সে শুনতে চাইবে? ভালবাসার সাথে শোনাতে হবে। সেইজন্য লোক খুঁজতে হয়—যাকে সে ভালবাসে, যার ওপর টান আছে, যার কথা শোনে। কেমন কথা শোনাতে হবে? যাতে সে ইষ্টপথে চলে, মঙ্গলের অধিকারী হয়—তেমনতর কথা। বুঝতে পারছ তো? (বোধিব্যাসকে প্রশ্ন করলেন।)

বোধিব্যাস ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—উচ্ছৃঙ্খল ব’লতে কী বুঝব? বিশৃঙ্খল, যথেচ্ছাচারী, অনিয়ন্ত্রিত, বিধি-নিয়ম মানে না যে সে-ই উচ্ছৃঙ্খল। তাহ’লে উচ্ছৃঙ্খল মানে যা’ খুশি তা-ই করা? যেমন, পড়ার সময় খেললাম, খেলার সময় ঘুমালাম, ঘুমানোর সময় অযথা ঘুরে বেড়ালাম ইত্যাদি। কোন কাজের সঙ্গে কোন কাজের শৃঙ্খলা যার স্বভাবের মধ্যে নাই সে-ই উচ্ছৃঙ্খল।

তাহ’লে কী হ’ল? ঠাকুর এখানে কী বলছেন? যে পতিত অর্থাৎ জীবনবৃদ্ধির পথ থেকে যে বিচ্যুত তার মঙ্গলের জন্য যা-যা করার তা-ই করতে বলছেন। ঠাকুর কাকে করতে বলছেন? আমাকে বলছেন। যে বাণীপাঠ করছে তাকেই বলছেন। তার (যে পতিত) প্রাণে আশার সঞ্চার করা—যাতে সে হতাশ হ’য়ে না পড়ে, তার অন্তরে সাহস জাগিয়ে দেওয়া এবং তার উন্নয়নে সাহায্য করার কথা বলছেন। কিন্তু যাতে সে উচ্ছৃঙ্খল না হ’য়ে পড়ে, খেয়াল-খুশিমত কাজ না ক’রে বসে—সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে বলেছেন।

[ ইষ্ট-প্রসঙ্গে/ তাং-৬/১০/৭৬ ইং ]

[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ২৮০ -২৮১]