কোনপ্রকার সংস্কারেই … বন্ধন। – ব্যাখ্যা

সত্যানুসরণ -এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:

কোনপ্রকার সংস্কারেই আবদ্ধ থেকো না, একমাত্র পরমপুরুষের সংস্কার ছাড়া যা’-কিছু সবই বন্ধন।

পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :

শ্রীশ্রীপিতৃদেব শ্যামাপদ সৎপতিকে বাণীটি আলোচনা করার জন্য বললেন।

শ্যামাপদ—আমাদের অনেক রকমের সংস্কার থাকে। যেমন, কুলগুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়া একটা সংস্কার। আমরা কুলগুরুর দীক্ষা নিই। কুলগুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে আবার অন্য গুরুর কাছে যেতে পারি। আমরা অনেকে এ-ভাবে গুরুকরণ করি। কিন্তু এ-ভাবে বন্ধন ঘোচে না। যখন পুরুষোত্তমের দীক্ষা নিই তখন আর কিছু করার দরকার হয় না। তখন বন্ধন থেকে মুক্ত হই।

এবার সমুখে বসা দাদাদের প্রতি তাকিয়ে শ্রীশ্রীপিতৃদেব প্রশ্ন করলেন—কি, বোঝা গেল?

তারা অনেকেই জানালেন—বাণীটির অর্থ মোটেই পরিষ্কার হয়নি।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব (শ্যামাপদকে)—বল্‌, সংস্কার মানে কি? তুই যে কুলগুরুর কথা তুললি—কুলগুরু কাকে বলে?

—সংস্কার মানে গোঁড়ামি। আর, কুলগুরু মানে—কুলের বা বংশের যিনি গুরু।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—কুলগুরু মানে তা না। যিনি আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত জানেন তিনিই কুলগুরু। কুলগুরু হওয়া অত সোজা না! বল্‌ গোঁড়ামি কোনটা?

—অনেকেই মাছ-মাংস খাই, পাঠা বলি দিই—অথচ এ-সব ভাল কি মন্দ জানি না—এগুলো গোঁড়ামি।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সংস্কার মানে কি গোঁড়ামি?

আলোচনায় শব্দগুলির অর্থ পরিষ্কার হচ্ছে না দেখে শ্রীশ্রীপিতৃদেব তাঁর বিছানার উপর রাখা অভিধানখানি খুলে সংস্কার শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ পাঠ করে শোনালেন।

পরে জিতেনদা (দেববর্মন) বললেন—ঠাকুরের বলা আছে—

“অভ্যাসেরই ঝর্ণা হতে 
                জন্মে সংস্কার, 
  সম্তানেতে বংশক্রমে
                 তারই তো সঞ্চার।” 

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—কোন কাজ করতে-করতে যখন অভ্যাসে গেঁথে যায় তখন তা সংস্কার হয়ে দাড়ায়।তা ভালরও হতে পারে, মন্দেরও হতে পারে।

হরিপদদা (দাস)—শুনেছি, সধবা হিন্দু রমণীদের এ-রকম সংস্কার আছে যে মাছ না খেলে স্বামীর অকল্যাণ হয়। এ-রকম কেউ যদি শ্রীশ্রীঠাকুরের সৎমন্ত্র নিয়ে জানল যে তিনি (শ্রীশ্রীঠাকুর) মাছ খাওয়া পছন্দ করেন না। কিন্তু সংস্কারবশতঃ স্বামীর অকল্যাণের ভয়ে তখনও সে যদি মাছ খেয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে যে সে সংস্কারে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আর তাই বন্ধন।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, এ-রকম অনেক প্রকারে হতে পারে। যেমন ধর্‌, দুবেলা প্রার্থনা করি, করতে-করতে সংস্কারে পরিণত হয়েছে, কিন্তু যাঁর প্রার্থনা করছি, তাঁর দিকে মতি নাই, তিনি যেমন চান, তা আচরণে ফুটে উঠছে না—তাহলে বুঝতে হবে যে সংস্কারবশতঃ প্রার্থনা করছি, আর তা-ই বন্ধন। যখন আসলকে ছেড়ে উপলক্ষকে নিয়ে মেতে আছি তখনই আবদ্ধ হয়ে পড়ছি।

প্রার্থনা মানে কী? তাঁর প্রার্থনা করে হৃদয়ে শাস্তি প্রতিষ্ঠা করি, স্বস্তি লাভ করি—সেইটাই প্রার্থনা। আমরা পরম দয়াল শ্রীশ্রীঠাকুরের দীক্ষা পেয়েছি। আমাদের কী করা প্রয়োজন? আমাদের লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যেন কাউকে ছোট মনে না করি, সবাইকে ভালবাসতে পারি—প্রেমের অধিকারী হতে পারি। যে কর্মের দ্বারা এ-রকম সংস্কার গজায় সেই সংস্কারই পরমপুরুষের সংস্কার। তাঁকে (প্রি়য়পরমকে) হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই তা সম্ভব—প্রার্থনা তো সে জন্যই।

[ পিতৃদেবের চরণপ্রান্তে/তাং-১৩/৬/৭৯ ইং ]

[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ৬৮, ৬৯]