সত্যানুসরণ -এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
“যদি পরীক্ষক সেজে অহঙ্কার নিয়ে সদগুরু কিংবা প্রেমী সাধুগুরুকে পরীক্ষা ক’রতে যাও, তবে তুমি তাঁতে তোমাকেই দেখবে, ঠ’কে আসবে।“
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
বিভিন্ন ভাষায় বাণীটি পাঠের পর প্রশ্ন তুললেন তপোবন বিদ্যালয়ের শিক্ষক হরিপদদা—অহঙ্কার নিয়ে পরীক্ষা কেমন ক’রে হয়?
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—দেখি কেমন সাধু, অনেক তো নাম শুনি; এই ভাব নিয়ে তো অনেকে মহাপুরুষ দর্শনে আসে।
বিনায়কদা (ডাঃ বিনায়ক মহাপাত্র)—তাঁতে তোমাকেই দেখব—কেমন?
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, এটাই এখানে আলোচ্য বিষয়। হরিপদ আলোচনা করুক।
হরিপদদা ইতস্ততঃ করছেন দেখে শ্রীশ্রীপিতৃদেব প্রশ্ন তুললেন—তুই যখন দীক্ষা নিলি তখন তোর বয়স কত ছিল?
হরিপদদা—২৫।২৬ হবে।
—কার কাছে দীক্ষা নিয়েছিলি?
—ভজহরিদার কাছে।
—ঠাকুরের কথা কোথায় শুনলি?
হরিপদদা পুরানো দিনের কাহিনী বলতে থাকেন—ভজহরিদার কাছেই প্রথম ঠাকুরের কথা শুনলাম। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞানের নানারকম প্রশ্ন তুললাম। ভজহরিদা বলেছিলেন, কেমন ক’রে, আত্মিক উন্নতি হয়, ভালভাবে জীবন যাপন করা যায় কিভাবে—ইত্যাদি।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তোর প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পেলি কি-না?
হরিপদদা—সব প্রশ্নের উত্তর পাইনি। আমার তো নানান ধরনের প্রশ্ন ছিল।
—তাহলে তুই দীক্ষা নিলি কী দেখে?
—ভজহরিদা বললেন সি-আর-দাশ (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ) দীক্ষা নিয়েছেন। কেষ্টদা ( ঋত্বিগাচার্য্য স্বর্গত কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য) শ্রীশ্রীঠাকুরের একজন পরম ভক্ত। এছাড়া বহু বিদ্বান, বিচক্ষণ ব্যক্তি ও দেশনেতার নাম করেছিলেন। কিভাবে তাঁরা এলেন, এখানে এসে কী খুঁজে পেলেন—ইত্যাদি অনেক কথা বলেছিলেন। সব শুনে আমার মনে হ’ল আমিও তো কিছু পেতে পারি।
—ভজহরিদাকে প্রশ্ন করিস্ নি এটম সম্বন্ধে?
—ঠিক মনে নেই, তবে বহু প্রশ্নেরই মীমাংসা তখন হয় নাই। তবে মনে হয়েছিল, এভাবে পরীক্ষা করতে গেলে কিছু পাওয়া যাবে না।
—এখন-বল্ ‘তাঁতে তোমাকেই দেখবে, ঠ’কে আসবে’ এর অর্থ কী?
সকলকে নিরুত্তর দেখে তিনি বললেন—কেউ হয়ত ঠাকুরের কাছে এসেছে দর্শনের জন্য ৷ তার বিশ্বাস নাই যে ঠাকুর অন্তর্যামী। সে শুনেছে যে ঠাকুর মাছ-মাংস খাওয়া পছন্দ করেন না। কিন্তু মনে পরীক্ষা করার ইচ্ছা। ভাবছে—ঠাকুর যদি আমাকে মাছ খেতে বলেন তাহলে বুঝব যে তিনি সত্যিই অন্তর্যামী। সে ঠাকুরের সামনে এগিয়ে যেতেই একাধিকবার ঠাকুর বললেন তাকে লক্ষ্য ক’রে—’ধুর শালা, মাছ খাবি না।’ তাহলে কি বুঝব ঠাকুর অন্তর্যামী না! সে তো এই ভাব নিয়েই ঠাকুর দর্শনে এসেছে যে ঠাকুর অন্তর্যামী নন। তাই ঠাকুরের কথার মধ্যে সে নিজের ভাবটাই খুঁজে পেল,—ঠাকুরের মধ্যে নিজেকেই দেখতে পেল।
অতঃপর শ্রীশ্রীপিতৃদেব কয়েকটি ঘটনার অবতারণা করলেন।—একবার এক সাধু ঠাকুর-দর্শনে এসেছিল। পরীক্ষক সেজে পরীক্ষা করে বেড়ানো তার অভ্যাস। কথাবার্তায় প্রেমভক্তির গন্ধও নেই। ঠাকুরের কাছে এসে সরাসরি ঠাকুরকে প্রশ্ন করে বসল—ঠাকুর আপনি কি ভগবান? ঠাকুর তার দিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে বললেন—কলা, কলা, কলা। উত্তর পেয়ে সে মহাখুশি! বলতে লাগল, ঠাকুর ভগবান না। অহঙ্কার নিয়ে এসে যা মনে-মনে চাইছিল তা-ই পেল তাঁর কাছে।
আর একটা ঘটনা বলি। আমাদের পাবনা আশ্রমের ঘটনা। আশ্রমের অনতিদূরে চৌমাথায় রমেশের (চক্রবর্তী) উত্তরমুখী একটা দোকান ছিল। একদিন বিকালবেলা ঐ দোকানের পথ দিয়ে যেতেই দেখি দোকানের সামনে একজন ভদ্রলোককে উপস্থিত লোকেরা প্রণাম করছে। সব গ্রামের লোক; জিজ্ঞাসা করছে—কখন এলেন। অনেকদিন পর আপনার দর্শন পেলাম—ইত্যাদি। উনি উত্তরে বললেন—ঠাকুরের নাম শুনে বহুদিন থেকে আসব ভাবছিলাম। তা এসে দেখলাম, ঠাকুর ভক্তজনদের নিয়ে বসে আছেন। আর, তাদের সঙ্গে শুধু সাপ ব্যাঙের গপ্প। সব দেখে মনে হ’ল ধ্যাৎ, ফিরে যাই। হরিকথা শুনব ভেবে এলাম, আর কি না শুধু সাপ ব্যাঙের গপ্প। কথা শুনে পথের মাঝে থমকে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞাসা ক’রে জানলাম, উনি একজন স্বনামধন্য গোঁসাই। আমি আরো একটু এগিয়ে গোঁসাইজীকে বললাম—একটা কথা বলব? আপনি কি এই শ্লোকটা জানেন?
উনি বললেন—কী শ্লোক? আমি বললাম—’হরির উপর হরি হরি শোভা পায়/হরিকে দেখিয়া হরি হরিতে লুকায়।’ উনি বললেন—না তো শুনিনি। তখন আমার চেহারা অনেক পাতলা ছিল, কিন্তু লোকে আমাকে শ্রদ্ধা করত, ভালবাসত—ভয়ও করত অনেকে । তাই আমাকে দেখে অনেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলত । গোঁসাইজীর সঙ্গে কথা বলছি দেখে পাশাপাশি যারা ছিল তারাও কৌতুহলবশতঃ কাছে এল। গোঁসাইজীকে বললাম—পুকুরে জলের ওপরে পদ্মপাতা, তার ওপর একটা ব্যাঙ ভেসে আছে। অদূরে একটা সাপও ব্যাঙটাকে ধরার জন্য এগিয়ে আসছে। সাপকে দেখে ব্যাঙ জলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। সকলে তখন আমার কথা শুনে হাসছে। কিন্তু গোঁসাইজীর গম্ভীর ভাব; হয়তো আমার কথা তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। যাই হোক, আর কিছু না ব’লে তিনি বাড়ির পথ ধরলেন।
ননীদা (চক্রবর্তী)—একবার এক দাদা আশ্রমে এসে বহুলোক প্রণামীসহ ঠাকুর-প্রণাম করছে দেখে মন্তব্য করল—ও বুঝেছি, এখানেও টাকার খেলা।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তাকে বলতে পারতেন, দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় খেলা হ’ল টাকার খেলা; আপনি এরকম একটা খেলা খেললেই পারেন।
এরকম লোককে চেপে ধরতে হয়। সেই সাধু যে জিজ্ঞেস করেছিল “ঠাকুর আপনি কি ভগবান?” বসওয়ান (সিং) তো তাকে চেপে ধরেছিল। এসব ক্ষেত্রে প্রথমে মিষ্টি ক’রে বলতে হয়। তারপর গরম হ’তে হয়। ঠাণ্ডা থেকে শুরু করে ক্রমশঃ dose (মাত্রা) বাড়িয়ে যেতে হয়।
পণ্ডিতদা—আজ্ঞে, আপনি একবার দেওঘর টাউনের দিকে যাচ্ছিলেন। কয়েকজন যুবক ঠাকুরের নামে বিরূপ মন্তব্য করেছিল, আপনি একাই যেভাবে tackle করলেন ওরা সব দমে গেল, ক্ষমাপ্রার্থনা করল।
ঘটনাটা শোনার জন্য অনেকেই ঔৎসুক্য প্রকাশ করায় শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—সে অনেক দিনের কথা। আমরা পাবনা থেকে পরমদয়াল শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে কিছুদিন হ’ল এখানে (দেওঘর) এসেছি। তখন আমি গোলাপবাগে থাকতাম। ঠাকুরের জন্য ঘি আনতে বৈদ্যনাথধাম বাজারে যাচ্ছি। পুরানদা হ’য়ে হাঁটাপথে রেললাইনের কাছাকাছি গেছি। দেখি ৭।৮ জন যুবক ঐ রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। ওদের কাছ থেকে নিন্দাবাদসূচক কিছু কথাবার্তা কানে এল। মনে হ’ল ঠাকুরের সম্বন্ধেই। দাঁড়িয়ে পড়লাম। ওরা লেভেল ক্রসিঙে এসে রেললাইন ধ’রে স্টেশনের দিকে হাঁটা দিল। ওদের পিছু নিলাম। একটু এগিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা কার কথা ক’চ্ছেন?
ওরা বলল—এই যে এখানে আশ্রম করেছে, অনুকূল ঠাকুর . . .
—তার কী হয়েছে?
ওদের একজন বলল—আমার পিসেমশাই তার শিষ্য।
—কে আপনার পিসেমশাই?
—প্রভাত হালদার, হাওড়া জেলায় বাড়ি। তার জায়গা, বাড়ি, টাকা-পয়সা সব ঠাকুর নিয়ে নিয়েছে।
—তার মানে? ঠাকুর কি সব হাওড়া থেকে তুলে এনেছেন?
—না, মানে ঠাকুরকে সব দিয়ে দিয়েছে।
—নিয়ে নেওয়া আর দিয়ে দেওয়া এক হ’ল নাকি? আমি প্রশ্ন করলাম। ওর মুখে তো আর কথা যোগায় না। জিজ্ঞাসা করলাম—ঠাকুর-দর্শন হয়েছে?
আমার প্রশ্নের উত্তরে আমতা-আমতা করে কিছুকথা বলল। শেষে বলল—এখানে (দেওঘর সংসঙ্গ আশ্রম) যাইনি, পাবনায় গেছি।
—পাবনায়? কোন্ পথে যেতে হয়?
—ঈশ্বরদি।
—ঈশ্বরদি, তারপর কী?
আর কিছু বলতে পারে না। হয়ত ঈশ্বরদি নামটা কারো কাছে শুনে থাকবে।
ততক্ষণে ব্রীজের ওপরে এসে গেছি। তার সঙ্গীদের বললাম—দেখছেন, ও নিজে কিছু জানে না, ঠাকুর-দর্শনও করেনি; একজন মহাপুরুষ সম্বন্ধে আজে-বাজে কথা বলছে। আর আপনারাও তাই শুনছেন!
আমার তখন অসম্ভব রাগ চেপে গেছে। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললাম—ফাজিল কাঁহাকার, ফাজলামোর আর জায়গা পাওনি? ঠাকুর-দর্শন না ক’রে, কিছু না জেনে তাঁর সম্বন্ধে যা-তা ক’চ্ছ? যাঁর দর্শনে মানুষের জীবন ধন্য হয়, লক্ষ-লক্ষ লোক যাঁর পূজা করছে, তাঁর নামে নিন্দা!
ওরা দলে ভারী। সকলেই খুব গরম। এগিয়ে এসে বলে—মারবেন নাকি!
—শালা, শুধু মারব। মনে হচ্ছে এক-একটাকে ধ’রে ঘুসি মেরে দাঁত খুলে নীচে (সেতু থেকে ২৫/৩০ ফুট নীচের জায়গা) ফেলে দিই। গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা নাই, বাপ-ঠাকুরদার ওপর ভক্তি নাই, মহাপুরুষের নামে নিন্দা—! শালা এক নম্বর হারামী, জন্মের দোষ নাহলে এমন বলে!
ওরা তখন পিছিয়ে গেছে কয়েক হাত। তারপর কাঁচুমাচু হয়ে বলল—দোষ হয়ে গেছে। ক্ষমা করুন। ক্ষমা করুন দয়া করে! আর অমন বলব না!
বললাম—আর কখ্খনো অমন করবেন না, খুব খারাপ জিনিস। তিনি মহাপুরুষ, অবতার! তাঁর শরণ-মননে জন ও জাতির পরম মঙ্গল হয়, পরম কল্যাণ হয়। শ্রদ্ধাভক্তিসহকারে মহাপুরুষদের প্রসঙ্গ আলাপ-আলোচনা করতে হয়। কখ্খনো অমন বলতে নেই। ব’লে বাজারের দিকে চলে গেলাম। পরের দিন ওদের মধ্যে একজন আশ্রমে এসে ক্ষমা প্রার্থনা চেয়ে দীক্ষা নিয়ে গেল।
সতীশদা (পাল)—যে বিক্রম ওরা দেখল তার কাছে সবাই কাবু হয়ে গেল। ওরা ৭/৮ জন থাকলেও আপনার সামনে দাঁড়াতে পারল না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—যখন কোন মহাপুরুষ সম্বন্ধে, ইষ্ট সম্বন্ধে পিতামাতা বা গুরুজনদের অপবাদ কানে আসে তখন কোন যুক্তি বা তথাকথিত ভদ্রকথাও মুখ দিয়ে বেরোয় না; কোন যুক্তি অবতারণা করার ফুরসুৎ-ই নাই। তখন অস্ত্র—সর্বচূর্ণ গদার বাড়ি’!
[ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-২৪/১২/৭৫ ইং]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ৫২-৫৫]