পিতার জন্য, … পাবে। – ব্যাখ্যা

সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:

পিতার জন্য, সত্যের জন্য দুঃখ ভোগ কর, অনন্ত শান্তি পাবে।

পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :

বোধিব্যাস—পিতার জন্য, সত্যের জন্য কোন কাজ করতে গেলাম। এতে দুঃখ ভোগ হ’ল। পরে শান্তি লাভ করলাম।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—পিতার জন্য মানে কী?

—ঠাকুরের জন্য।

—ঠাকুরের জন্য কেন? তাহলে ‘ঠাকুরের জন্য’ লেখা থাকত। বুঝিয়ে দাও।

বোধিব্যাসকে নিরুত্তর দেখে তিনি কৃতিকে (গাঙ্গুলী) ঐ প্রশ্ন করলেন।

নির্দেশ পেয়ে কৃতি উত্তর দেয়—পিতার জন্য মানে পরমপিতার জন্য, সত্যের জন্য মানে ইষ্টের জন্য । সৎ মানে যা’ জীবনবৃদ্ধির সহায়ক।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—পিতা বলতে পিতা, পরমপিতা সবই বোঝায়। সৎ মানে যা জীবনবৃদ্ধির সহায়ক। সৎ মানে জীবনবৃদ্ধির সহায়ক কেমন ক’রে হ’ল?

কৃতি—সৎ যা’ তা’ আমাদের উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। সত্য মানে মঙ্গল।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—যিনি বিশ্বপিতা তিনি পিতা, পরমপিতা। এ না হয় বোঝা গেল। সত্য মানে কী হবে?

—যার অস্তিত্ব আছে, বিকাশ আছে—তাই সত্য।

—তাহলে তো মাইকেরও অস্তিত্ব আছে, বিকাশ আছে। তাতে কী হয়েছে?

গুছিয়ে বল, তাহলে তো বুঝতে পারব।

কৃতি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছে না দেখে তিনি অমিয়কে বলতে বললেন।

অমিয়—যার অস্তিত্ব আছে, বিকাশ আছে তাই সত্য।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সব জিনিসেরই তো অস্তিত্ব আছে, বিকাশ আছে। কিরকম অস্তিত্ব আছে, বিকাশ আছে?

অমিয় কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে তিনি শ্যামাপদকে (সৎপতি) ঐ প্রশ্ন করলেন।

শ্যামাপদ—সত্য মানে ইষ্ট। —সত্য-র মূর্ত প্রতীক ইষ্ট। সুতরাং ইষ্টের জন্য যদি দুঃখ ভোগ করি তাহলে অনন্ত শান্তি পাব।

—সত্যের মূর্ত প্রতীক ইষ্ট—সেটা কেমন ক’রে? বুঝিয়ে দাও।

শ্যামাপদর উত্তর ঠিকমত না হওয়ায় তিনি হরিপদদাকে (দাস) ঐ প্রশ্ন করলেন।

হরিপদদা—এখানে পিতা হচ্ছেন পরমপিতা, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। আর ‘সত্য’ কথাটি এসেছে অস্‌ ধাতু থেকে। অস্‌ মানে বিদ্যমানতা। যা নিত্য, যা শাশ্বত তাই সত্য। একমাত্র পরমপিতাই নিত্য, শাশ্বত। পরমপিতার মূর্ত প্রতীক হলেন ইষ্ট। তাই তাঁর জন্য (ইষ্টের জন্য) যত দুঃখই আসুক তাতেই শান্তি।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ। ঈশ্বরের মূর্ত প্রতীক হলেন ইষ্টদেব, তিনি নিত্য, শাশ্বত। তিনি বিদ্যমানতার মূর্ত প্রতীক। ঈশ্বরকে তো চোখে দেখিনি। কেউ কেউ দেখতে পারে। তাই তাঁর (ঈশ্বরের) মূর্ত প্রতীক যিনি, যিনি ইষ্ট তাঁর সেবা করাতেই শান্তি। তাঁর পথে চলতে গিয়ে, তাঁর কাজ করতে গিয়ে যত বাধাবিঘ্নই আসুক, যত দুঃখকষ্টই আসুক—তাতেই চরম শান্তি।

এই যে চোখের সমুখে বইখানি দেখছি তা কিছুদিন পর থাকবে না। ঘড়ি দেখছি, তা-ও কিছুদিন পর থাকবে না। আমি আছি, কিছুদিন পর থাকব না। কিন্তু তিনি ছিলেন, আছেন ও থাকবেন।

যতদিন সৃষ্টি আছে ততদিন ঈশ্বর আছেন। ঈশ্বর থেকেই সৃষ্টি। আবার সৃষ্টির আগে ও পরেও তিনি থাকেন। তিনি সত্য, তাই যে কোন অবস্থায় থাকি না কেন তাঁর কাজেতেই শান্তি।

[ইষ্ট-প্ৰসঙ্গে/তারিখ-১২/৬/৭৭ ইং]

ফাল্গুনী রায়চৌধুরী বাণীটি আলোচনার নির্দেশ পেয়ে পুনরায় পাঠ করে বলল—পিতা মানে ভগবান, ইষ্ট । সত্য মানে যার অস্তিত্ব ও বিকাশ আছে। আমি যদি ইষ্টের জন্য দুঃখভোগ করি—

শ্ৰীশ্রীপিতৃদেব—ইষ্টের জন্য মানে কি?

—সৎ পথে চলার জন্য যে বাধাবিঘ্ন আছে—ইষ্টকে মেনে চলার জন্য—

শ্ৰীশ্রীপিতৃদেব—কেন? আর কিছুর জন্য হতে পারে না?

— তাঁকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তাঁকে প্রতিষ্ঠা করার কি ক্ষমতা আছে আমার?

—আমি মেনে চলব, অন্যে যাতে মেনে চলে তা দেখব।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—বাণীতে কি আছে?—পিতার জন্য। পিতা মানে সদগুরু, পরমপিতা। ইষ্টই ধরলাম। পিতাকে মেনে ভালই তো হবে। কিন্তু ইষ্টকে, ঠাকুরকে মেনে চলার জন্য দুঃখ ভোগ কেন করব?—এগুলো তো আলোচনা করবি!—তারপর কি আছে?

—“অনন্ত শান্তি পাবে”। তাঁকে মেনে চললে অনন্ত শান্তি পাব।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তাঁকে মেনে চলবি কিভাবে?

—তাঁর অনুশাসনবাদ মেনে চলব।


শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সহজ করে বল্‌ না! পরমপিতা বা ঠাকুরকে খুশী করার জন্য, তাঁকে প্রীত করার জন্য যত কষ্টই পাই, দুঃখই পাই তার মধ্যেও শান্তি পাব। যা কিছু করতে হবে শুধু তাঁর জন্য, কারণ তিনিই সব। তাতে কি হবে?

—অনন্ত শান্তি পাব।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—শান্তি পাব কিভাবে?

—তিনি খুশী হবেন তাই কষ্ট করছি, তাঁকে খুশী করার জন্য দুঃখ পাচ্ছি।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তিনি না হয় খুশী হলেন কিন্তু আমি দুঃখ পেলাম কিভাবে? (ক্ষণিক থেমে) আমরা সাধারণতঃ দুঃখ ভোগ করি কি থেকে?

—চাওয়াটা না পাওয়াই দুঃখ।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—আমরা কি চাইছি সব সময়? কি পাচ্ছি না? সাধারণতঃ আমরা লোভের জন্য দুঃখ পাই, ক্রোধের জন্য দুঃখ পাই। কোন হিতাহিত জ্ঞান থাকল না। লোভে পড়ে টাকা নিয়ে ফেললাম। কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মাৎসর্য্য আছে তো, ওদের জন্যই দুঃখ পাই। শেষকালে দুঃখ দুঃখই থেকে যায়—শান্তি পাই না। কিন্তু তাঁর সোয়াস্তির জন্য যা করি না কেন শান্তি পাব। তখন আস্তে আস্তে সবাই ভালবাসবে । কারণ আমি লোভে পড়ে তো করছি না, ক্রোধে পড়ে করছি না—আমি তাঁর সোয়াস্তির জন্য করছি। তিনি কল্যাণের মূর্ত্ত প্রতীক। সেইজন্য শান্তি পাব। নিজের লোভের জন্য, স্বার্থের জন্য যদি করা যায় তাহলে দুঃখ আসে—সব ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়।

[পিতৃদেবের চরণপ্রান্তে/তারিখ-২৯/৯/৭৯ ইং]

[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ১৬২ – ১৬৪]