সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
“বন্ধুর নিকট উদ্ধত হ’য়ো না, কিন্তু প্রেমের সহিত অভিমানে তা’কে শাসন কর।“
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীশ্রীপিতৃদেবের নির্দেশে আজ গীতা (মণ্ডল) ও মিনতি (গাঙ্গুলী) একবার করে বাণীটি পাঠ করল।
গতকাল আলোচিত বাণীটির “কিন্তু তাই ব’লে তার নিকট তার কোন মন্দের প্রশ্রয় দিও না”—এই অংশটি পরিষ্কার হয়নি। তাই শ্রীশ্রীপিতৃদেব সুপালীকে (চক্রবর্তী) বাণীটির উক্ত অংশ আলোচনা করতে বললেন।
সুপালী বাণীটি পাঠ করলে তিনি প্রশ্ন করলেন—নিন্দা করা কাকে বলে?
সুপালী—কারও সম্বন্ধে ভাল ছাড়া মন্দ বললে নিন্দা করা হয়।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—আর মন্দের প্রশ্রয় না দেওয়া কেমন? তার মানে, বন্ধুর কোন ত্রুটি দেখলে তাকে support (সমর্থন) না করা। তাকে তখন মিষ্টি করে বুঝিয়ে বলব যাতে সে অন্যায় বা মন্দ কাজ না করে। বুঝিয়ে বলতে যাব কেন? না, তা করলে তার খারাপ হবে, ক্ষতি হবে, আর তাতে আমিও ব্যথিত হব। তাই তার যাতে ভাল হয়, মঙ্গল হয় সেরকম চিস্তা করব। যেমন ক’রে বললে সে আর মন্দ করবে না সেভাবে বুঝিয়ে বলব। এবার আজকের বাণী আলোচনা কর।
সুপালী বাণীটি একবার পাঠ ক’রে বলল—বন্ধুকে এমনভাবে বলব যাতে সে আর মন্দ না করে, তাকে শাসন করব।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—আর ‘প্রেমের সহিত’—একথার অর্থ বোঝা গেল না তো !
সুপালী—প্রেমের সহিত, ভালবাসার সহিত তাকে শাসন করব।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তাকে ভালবাসি, তাই অভিমানে তাকে শাসন করলাম।—এটা বুঝাতে গেলে একটা উপমা খাড়া করতে হয়।
সুপালীকে নিরুত্তর দেখে রানীকে (মুখার্জী) বাণীটি বুঝিয়ে দিতে বললেন।
রানী—বন্ধুকে খারাপ কাজ করতে দেখে আমি বন্ধুর উপর রেগে যাব না, অন্তরে টান রেখে তাকে শাসন করব।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—খারাপ কাজ কাকে বলে?
রানী—যেমন চুরি করা।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—খারাপ বলি কেন? সেটা বলতে হবে তো! খারাপ কাজ কাকে বলে শান্তদীপা?
শান্তদীপা সঙ্গে-সঙ্গেই উত্তর দিল—যে কাজ কেউ পছন্দ করে না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—পছন্দ করে না কেন?
শান্তদীপা এখন নিরুত্তর। তাই শাশ্বতীকে বলতে বললেন।
শাশ্বতী—জীবন-বৃদ্ধির যাতে ক্ষতি হয় তা-ই খারাপ।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—জীবনবৃদ্ধির যা’ অন্তরায় তা-ই খারাপ—তা-ই পাপ। আর তা-ই পুণ্য যা’ জীবন-বৃদ্ধির সহায়ক।
একটু আগে রানী চুরির উদাহরণ দিয়েছিল। সেই উদাহরণের প্রসঙ্গ ধরে শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন— চুরি করাটা খারাপ কিজন্য? যে চুরি করছে সে তো বলবে চুরি না ক’রে থাকতেই পারব না, চুরি না করলে খাব কী? সে বলবে আমি আজ যদি চুরি না করি আমার বাড়ির সব না খেয়ে মরবে। তাহলে সে তো জীবন-বৃদ্ধির জন্য চুরি করছে। ঠাকুরের ছড়ায় কী আছে যেন—
“অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে
ধৰ্ম্ম ব’লে জানিস তাকে!”
তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল?
সকলকে নির্বাক দেখে শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—চুরি করা খারাপ, কেননা তা অন্যের বাঁচা-বাড়াকে ব্যাহত করে। স্কুলে অনেক ছেলে বই, খাতা, পেনসিল চুরি করে—সেই উদাহরণ দিয়ে বল না?
রানী—আমার বন্ধু কারও বই চুরি করেছে, তখন ভিতরে টান রেখে তাকে শাসন করব।
সুপালী—কথা বলব না ওর সঙ্গে।
শ্ৰীশ্রীপিতৃদেব—অভিমান ক’রে যদি বলি—তোমার সঙ্গে কথা বলব না, তাহলে এক হয়। আর যদি তা না হয়! সোজা কথায় সহজ করে বুঝিয়ে দিতে হবে তো! (ছেলেদের দিকে তাকিয়ে হৃষীকেশকে বললেন) বাণীটা বুঝিয়ে দাও। (ক্ষণিক থেমে) ভালবাসা থাকলে অভিমান হয়; তোমার বন্ধু কারও বই চুরি করেছে। তুমি বন্ধুকে বললে—তোমাকে সবাই ভালবাসে, আমিও ভালবাসি, তুমি এমন কাজ করেছ! আমি তো expect (আশা) করতে পারিনি; তোমার কাজটা দেখে আমার ভারী কষ্ট হ’ল। স্বপ্নেও ভাবিনি, কল্পনাও করতে পারিনি—তুমি এমন কাজ করতে পার। তারপর দু’চারবার এরকম ক’রতে ক’রতে বইটা যার ছিল তাকে সে দিয়ে দিল। আবার আগের মত কথা বলা শুরু করলে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব পুনরায় বললেন—ভালবাসার expression (প্রকাশ) যদি না থাকে, অবজ্ঞার ভাব যদি থাকে তাহ’লে অভিমান কি-ক’রে প্রকাশ পাবে? ভালবাসার একটা form (রূপ) হ’ল অভিমান। এইরকম অভিমান না থাকলে বন্ধুকে শাসনও করা যাবে না।
পরমেশ্বরদা (পাল)—বন্ধুকে বিপথগামী দেখে যদি তার সঙ্গে অসহযোগ করি, তখন—
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সে-রকম হ’লে বুঝতে হবে ভালবাসা হয় নাই। আর তাই সেখানে অভিমানও হয় না, ঘৃণা করা হয়।
সতীশদা—অভিমানে ভালবাসা আরও বেড়ে যায়।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, সাধকরা শিষ্যদের উপর অনেক সময় অভিমানে বকা-ঝকা ক’রে থাকেন। তবু তারা গুরুর সঙ্গ ছাড়ে না। কারণ, তারা অনুভব করে তাদের মঙ্গলের জন্যই, ভাল-র জন্যই গুরু ভর্ৎসনা করছেন।
[ ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-২/২/৭৬ ইং]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ৯০, ৯১]