সত্যানুসরণ -এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
বীর হও, কিন্তু হিংস্রক হ’য়ে বাঘ-ভালুক সেজে ব’স না।
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীশ্রীপিতৃদেব ধৃতিদীপীকে জিজ্ঞাসা করলেন—বীর কাকে বলে?
ধৃতিদীপী—যার গায়ে ক্ষমতা আছে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ক্ষমতা থাকলেই তাকে বীর বলব কেন? অনেকে তো খায়-দায়, গায়ে খুব শক্তি; কিন্তু লোকে কি বীর ব’লে তাকে জানে? (ক্ষণিক থেমে) তাহলে বীর কাদের বলব?
ধৃতিদীপী—যারা যুদ্ধ করে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—যারা যোদ্ধা, যারা যুদ্ধ করে তাদের সকলকেই কী বীর বলে? শক্তি আছে, সাহসও হয়ত অনেকের আছে, কিন্তু লাখ-লাখ সৈন্যের মধ্যে ‘বীরচক্র’ মাত্র কয়েকজনকে পেতে দেখা যায়। আসল ব্যাপার হ’ল, যুদ্ধক্ষেত্রেও অনেক কাজ থাকে যা’ সব সৈন্য করতে পারে না, কয়েকজন লোক হয়ত সেই কাজে এগিয়ে এল। সংসারক্ষেত্রেও সেইরকম। সেখানেও সাহস, বুদ্ধির দরকার। কাউকে-কাউকে দেখা যায় অবলীলাক্রমে বিপদসঙ্কুল ঝুঁকিবহুল কাজ ক’রে সফলকাম হয়।
যার শক্তি সাহস নির্ভরতা আছে, সংসারের সব কাজ হাসিমুখে করে, সংসারী লোকের মধ্যে সে বীর। কাউকে দেখা যায় exercise (ব্যায়াম) ক’রে, ডন-বৈঠক ক’রে শারীরিক শক্তি অর্জন করেছে; মানসিক শক্তিও আছে; গাঁয়ে ডাকাত এলে ডাকাতের দলকে একাই পিটিয়ে বের করে দেয়; সে-ও বীর। কিন্তু যাদের মধ্যে হিংসাভাব রয়েছে তারা শারীরিক ও মানসিক শক্তিকে ঠিকমত ব্যবহার করতে পারে না। তাদের ক্ষমতার অপচয় হয়। আবার কর্মনিষ্পন্ন করার বুদ্ধিও থাকা দরকার। কর্মনিষ্পন্ন না করলে বোঝা যাবে কী ক’রে সে বীর! ঠাকুর বলেছেন, হিংস্রক হ’য়ে বাঘ-ভালুক সেজে ব’স না। যারা হিংসা করে তাদের বিশ্বাস, নির্ভরতা, আত্মত্যাগ—এগুলি থাকে না। তারা নিঃস্বার্থভাবে অপরের জন্য করতে পারে না। অনেকের গায়ে শক্তি আছে, কিন্তু বিশ্বাসের অভাবে—নির্ভরতার অভাবে কর্ম নিষ্পন্ন করতে পারে না।
সতীশদা—বিশ্বাস মানে কি ঈশ্বরে বিশ্বাস?
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, তাই তো।
পূর্ব-প্রসঙ্গের সূত্র ধ’রে শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—বাঘ-ভালুকের মধ্যেও বীর আছে, পেট ভর্তি থাকলে অযথা পশুহত্যা করে না।
এ-প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীপিতৃদেব এক দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেন—একদিন Jim Corbett বনের মধ্য দিয়ে যেতে-যেতে এক ছাগলছানার ডাক শুনে থেমে গেলেন। এদিক-ওদিক তাকাতেই ছাগলছানাটি চোখে পড়ল। অদূরে এক বাঘিনীকেও দেখতে পেলেন। তিনি লুকিয়ে থেকে দেখতে লাগলেন বাঘিনী ছাগলছানাকে কী করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাগলছানাটি বাঘিনীর কাছে দৌড়ে এল। বাঘিনী তার গা শুকে চলে গেল। —ঘটনাটা Jim Corbett -এর বইতে পড়েছিলাম।
ক্ষণিক থেমে পুনরায় বললেন— কর্ম নিষ্পন্ন করার ক্ষমতা যার মধ্যে আছে তাকে সাধু বলা হয়। আর যে সাধু সে বীরও। সাধুর মধ্যে বীরের সব গুণগুলিই থাকে। আত্মত্যাগ না থাকলে সাধু হয় না।
[ ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-২৩/১/৭৬ ইং]
প্রদীপ পাল আলোচনা করছে। বাণীটি পুনরায় পাঠ করে বলল—বীর মানে শক্তিমান। হিংস্রক মানে যারা হিংসা করে। বাঘ-ভালুকের শক্তি আছে, ওরা আক্রমণ করে—ওদের হিংসাশক্তি আছে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—বীর হও মানে কি?
—শক্তিমান হও।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—শক্তিমান হয়ে কি হবে?
প্রদীপ—ঠাকুর বলছেন, সৎ কাজে বীর হও, অসৎ কাজে নিষেধ করছেন।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, সৎ কাজে মানে ভাল কাজে শক্তি ব্যয় করতে বলছেন। কারো জিনিস আছে, না দিলে মেরে কেড়ে নেব—তা’ যেন না হয়; ওতে বাঘ-ভালুকের মত হয়ে গেল।
প্রদীপ—বাঘ-ভালুকের মত হিংস্রক হতে নিষেধ করছেন।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—বীরের সাথে বাঘ-ভালুকের সম্পর্ক কি?—ঠাকুর বলছেন সৎ কাজে, কল্যাণের জন্য, মঙ্গলের জন্য বল প্রয়োগ কর। বাঘ-ভালুক বলটাকে প্রয়োগ করে জীবিকা অর্জন করে; নিজের উদরপূর্ত্তির জন্য হিংসার আশ্রয় নেয়। মানুষ হলে তা হবে না, সকলের মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে।
[ পিতৃদেবের চরণপ্রান্তে/তাং-২৭/৬/৭৯ ইং ]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ৮১, ৮২]