ভক্তি ভিন্ন সাধনায় ….. পারে।-ব্যাখ্যা

সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:

ভক্তি ভিন্ন সাধনায় সফল হওয়ার উপায় কোথায় ? ভক্তিই সিদ্ধি এনে দিতে পারে।

পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :

শ্রীশ্রীপিতৃদেব পূর্বকথার জের টেনে বললেন—ঈশ্বরকে বলে নিত্যবস্তু। (ভবানীদাকে) নিত্যবস্তু বলে কেন?

ভবানীদা—তিনি সবসময় আছেন, ছিলেন, থাকবেন।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ। (ক্ষণিক থেমে) লীলা মানে কী?

পরমেশ্বরদা—আজ্ঞে, লীলা মানে আলিঙ্গন করা।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—Embrace মানে আলিঙ্গন, গ্রহণ। লীলা মানেও তাই। লীলা মানে আলিঙ্গন, গ্রহণ হ’ল কেন? নিত্যলীলা কথাটি শোনা যায়। লীলা মানে কী?

উপস্থিত সবাইকে চুপচাপ দেখে শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—আমার মনে হয় absolute, (অখণ্ড অর্থাৎ ঈশ্বর) যখন ক্রিয়াশীল নন তখন তিনি যা’ হ’য়ে আছেন, তাই আছেন। সমুদ্র যখন নিশ্চল তখন absolute, কিন্তু যখন ঢেউ উঠছে-পড়ছে তখন সমুদ্র ক্রিয়াশীল। সমুদ্রেরই ঢেউ সমুদ্রেই হচ্ছে, আবার মিশে যাচ্ছে—তখন লীলা বা খেলা। জগৎ নিয়ে যখন তিনি খেলছেন তখন লীলা হচ্ছে। যখন তিনি নির্বিকার আছেন তখন তিনি অখন্ড, তিনি absolute. ভক্তিমার্গ তো! লীলা ধ’রেই অখন্ডে পৌঁছান ভক্তরা।

এবার পরমেশ্বরদা শ্রীশ্রীপিতৃদেবের দিকে তাকিয়ে নম্র সুরে বললেন—আজ্ঞে, এই তাঁর নিত্য লীলা। এই খেলাটাই নিত্য। ভগবান-ভক্তের এই যে খেলা এটাই নিত্য। এই জন্য জীবকে কখনও অনিত্য বলে না। তিনিও নিত্য, জীবও নিত্য। বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদে এ-রকম কথা আছে—সমুদ্রের মধ্যে নীল ছিটিয়ে দিলে সে-নীল সমুদ্রে মিশে গেলেও থেকেই যায় সমুদ্রের মধ্যে।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব ঘাড় নেড়ে পরমেশ্বরদার কথায় সম্মতি জানালেন।

জনৈক দাদা—“ভক্তিই সিদ্ধি এনে দিতে পারে’। এখানে সিদ্ধি মানে কি?

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—আমার যে-সব প্রবৃত্তি আছে সেগুলো control (নিয়ন্ত্রণ) করতে পারলে তাদের হাত থেকে আমি রেহাই পেলাম। তখনই সিদ্ধি, তখনই মুক্তি।

ভক্তি মানে ইষ্টানুরক্তি। ইষ্টানুরক্তি হ’লে প্রেম হয়। তখন রিপুগুলোকে লাগাম দিয়ে আমি ঘোরাই; আগে রিপুগুলিই আমাকে ঘোরাত। আমার complex, (বৃত্তি-প্রবৃত্তি)-গুলো যখন আমার control-এ আসে তখনই মুক্তি। তাদের (complex-গুলোর) বন্ধন থেকে আমি মুক্ত হলাম। ঠাকুরের এ-রকম বলা আছে।

অজিতদা (গঙ্গোপাধ্যায়) পাশেই বসেছিলেন। বললেন—আজ্ঞে, ঠাকুর বলেছেন মুক্তি মানে annihilation (অবলুপ্তি) নয়। সর্বগ্রন্থি থেকে বন্ধন-মুক্ত হওয়াই মুক্তি।

শ্ৰীশ্রীপিতৃদেব অজিতদার কথার সূত্র ধ’রে বললেন—ইষ্টস্বার্থের জন্য যখন প্রবৃত্তিগুলো আমার control-এ নিয়ে আসি তখনই সর্বগ্রন্থি মোচন হয়, নতুবা মায়ায় পেয়ে বসে। ভববন্ধন মানেও তাই—মায়ার দ্বারা পরিচালন। তখন complex-গুলো আমাকে পরিচালনা করে।

শ্যামসুন্দর প্রশ্ন করল—আজ্ঞে, নির্বাণ-প্রাপ্তির অবস্থা কি এরূপ? বৌদ্ধদর্শনের অনেক ভাষ্যকারের মতে নির্বাণ-প্রাপ্তি হ’লে আর জন্মাতে হয় না। আবার অনেকের মতে জন্ম-মৃত্যু ঐ নির্বাণ-প্রাপ্ত ব্যক্তির ইচ্ছাধীন।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, তখন ইষ্টসেবার জন্য আমি নিজের ইচ্ছামত জন্মাতে পারি। জন্মগ্রহণ তখন আমার হাতে। তখন আমার জন্ম নেওয়ার জন্য প্রয়োজন মত soil (ভূমি)-ও জুটে যায়।

[ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-৩০/১০/৭৩ ইং]

[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ২২১ – ২২২]