সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
“যদি প্রেম থাকে, তবে অপরকে আমার বল, কিন্তু স্বার্থ রেখো না।“
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীশ্রীপিতৃদেব সতীশদাকে (পাল) আলোচনা করতে বললেন।
সতীশদা—প্রেম মানে ভালবাসা, ভালতে বাস করা। যেহেতু ভালবাসি তাই তার মঙ্গলের জন্য যা’ যা’ করণীয় তা’ করি, মানুষের কাছে তার মহৎ গুণের কথা বলি। যখন যা বলেন, তা করি। মানুষের মধ্যে যখন প্রকৃত প্রেম আসে, তখন অপর সকলকে আমার বলে ভাবে। যেমন নিজের বন্ধুর জিনিসকে নিজের জিনিস বলে ভাবে। আর প্রকৃত প্রেম যেখানে আছে সেখানে কোন স্বার্থ থাকে না।
যেমন বন্ধুর বাড়িতে, বন্ধুর বিশেষ কাজের জন্য গিয়েছে বন্ধুর স্বার্থে। বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে। বন্ধু বিশেষ কারণে একটু বাজারে গিয়েছে, বাড়ির সবাইকে বলে গিয়েছে যে বন্ধুকে সময়মত খেতে দিতে, দেখতে। কিন্তু সবাই ভুলে গেছে কাজের চাপে। বন্ধুর যখন খুব খিদে পেয়েছে তখন কাউকে কিছু না বলে পাশে দোকান ছিল, সেখানে টিফিন করে এসেছে।
বন্ধু বাজার থেকে ফিরে, বাড়িতে খোঁজ নিল বন্ধুকে খেতে দেওয়া হয়েছিল কিনা। তখন সকলে একে অপরের দিকে তাকায়। অবশেষে বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করল। তার উত্তরে বলল, হ্যাঁ খেয়েছি।—দেখে মনে হচ্ছে বাড়িতে খাওনি। বন্ধু উত্তর দেয়—তুমি কিছু ভেব না বন্ধু, দোকানে টিফিন করে নিয়েছি, পরে খাব। আর দোকানে যে খেলাম সেটা তোমারই খাওয়ানো হচ্ছে। কারণ তোমার আর আমার কিছু তফাত তো নেই। তোমার মানে আমার। আমার মানে তোমার, তাই না বন্ধু। বন্ধুও ততখানি ভালবাসে বলে কিছু আর মনে করল না।
কিন্তু, মানুষ একজন অপর জনকে ভালবাসে স্বার্থের জন্য। তাই অপরকে আমার বলতে পারে না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—যারা মনেপ্রাণে ইষ্টস্বার্থী হয়, ইষ্ট ছাড়া কিছু বোঝে না, তাঁর সেবায় নিয়ত নিজেকে নিয়োজিত করে রাখে, এমন যে ইষ্টস্বার্থী মানুষ, সেই ব্যক্তির মধ্যে কোন স্বার্থ বোধ থাকে না; সবটাই ইষ্টের জন্য। নিজের জীবনটাই ইষ্টের জন্য উৎসর্গীকৃত। সেই ব্যক্তিই অপরকে আমার বলতে পারে। তার মধ্যে প্রকৃত পক্ষে কোন রকম স্বার্থ বোধ থাকে না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—গুরুকিঙ্করদার দিতে তাকাতেই গুরুকিঙ্করদা বললেন—আজ্ঞে , বোঝা যাচ্ছে। একদম পরিষ্কার।
[তাঁর সান্নিধ্যে/তাং-২৭/৩/৭৪ ইং]
ঋতেশ্বর মিশ্র আলোচনা করার নির্দেশ পেলেন। বাণীটি পুনরায় পাঠ করে বললেন—প্রেম মানে ভালবাসা। আমার মনের মধ্যে যদি ভালবাসা থাকে, তাহলে অপর যে কোন ব্যক্তি—সে আমার শক্র হোক, মিত্র হোক—ছোট হোক, বড় হোক আপন করে নিতে পারব। কিন্তু তাতে স্বার্থ রাখা চলবে না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—স্বার্থ যখন থাকে তখন ভক্তি থাকে না। নিঃস্বার্থ না হলে প্রেম হয় না। ভক্তির গাঢ়ত্বই প্রেম। কিন্তু যারা বয়সে ছোট তাদের প্রতি স্নেহ হয়,—ভক্তি হবে কি করে! প্রেম থাকা মানে কি?— প্রেম মানে ভক্তি থাকবে, ভালবাসা থাকবে। অন্তরে কার উপর ভক্তি-ভালবাসা থাকলে অপরকে ভালবাসতে পারবি?—ইষ্টের প্রতি অনুরাগ জন্মালে, তাঁকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালবাসলে, তখন সকলকে আমার বলে মনে হয়। স্বার্থ থাকলে তা হয় না। অন্যকে নিজের মত করে নেওয়ার মত যদি ভালবাসা বিদ্যমান থাকে তাহলে অপরকে আমার বলতে হয়। ভক্তি যখন ইষ্টের প্রতি অবাধ হয় তখন আর স্বার্থ থাকে না।
[পিতৃদেবের চরণপ্রান্তে/ তাং২২/৮/৭৯ ইং]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ১৩৩]