সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
যদি বিশ্বাস না কর, তোমার দেখাও হয় না, অনুভব করাও হয় না। আবার, ঐ দেখা ও অনুভব করা বিশ্বাসকেই পাকা ক’রে দেয়।
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
বাণীটির আক্ষরিক অর্থ বুঝতে কারও কোন অসুবিধা নাই দেখে শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—পরমপিতার দয়ায় আমাদের ভেতর বিশ্বাস ব’লে একটা বস্তু আছেই। আমাদের প্রত্যেকেরই বিশ্বাস আছে। (একটু থেমে) তাহ’লে ‘আমি এটা বিশ্বাস করি না’—এ-কথার অর্থ কী?
সতীশদা (পাল)—এটায় না থেকে অন্যটায় বিশ্বাস আছে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ। আমরা ধ’রে নিলাম বিশ্বাস আছেই। কিন্তু কেন? এই বিশ্বাস থাকার উদ্দেশ্য কী? Utility (উপযোগিতা) কী? পরমপিতা কেন তা’ আমাদের ভেতর দিয়ে রেখেছেন?
রামনন্দনদা (প্রসাদ)—বিশ্বাস না থাকলে জীবনই থাকত না।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সে তো ঠিক। কিন্তু আমার প্রশ্নের ওটা তো উত্তর হ’ল না। আসল ব্যাপার হচ্ছে তিনি বিশ্বাস দিয়ে রেখেছেন তাঁকে (পরমপিতাকে) উপভোগ করার জন্য। আবার অষ্টপাশ দিয়ে তিনি আমাদের চোখ বেঁধে রেখেছেন। কিন্তু তাঁকে যে আমাদের চাই-ই। তাঁকে যে উপভোগ করতে হবেই। ওই যে গতকাল বলা হ’ল—কত-কত বার আমরা ঘুরে-ঘুরে আসি।
গুরুকিঙ্করদা—পুরুষোত্তমকে পেলে এক জনমেই সব হয়ে যায়।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—শুধু পেলেই হবে না। ঠাকুর বার বার বলেছেন—লক্ষ জনম ধ’রে তাঁর গাড়ু-গামছা বইলেও কিছু হবে না, যদি তিনি যা’ যা’ বলেন তা’ তা’ না করি।
রামনন্দনদা—পরমপিতাকে উপভোগ করব কেমন করে?
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—পরমপিতা পরম সুখভোগের বস্তু। যখন তাঁকে উপভোগ করার মধ্যে থাকি তখন ওইটাই prominent (মুখ্য) হয়, আর সব আলুনি লাগে। অনেকেই স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ঘর-সংসার করে, কিন্তু পরমপিতার উপর গভীর টান। সব করে সে ঐ পরমপিতার সেবার উদ্দেশ্যে। সে মনে করে, আমি তাঁর দীন সেবক। সে মনে করে দুনিয়ার সবাই এ-রকম, সংসার করতে হয় করতে হবে, দায়িত্ব যা’ আসে পালন করতে হবে কিন্তু আসল লক্ষ্য তাঁকে খুশি করা। এরাই ইষ্টপ্রাণ। শুধু সংসার করলে কিছু হবে না। ইষ্টকর্মে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ালে স্ত্রী হোক, পুত্র হোক, বিষয়-আশয় যা-ই হোক—বিসর্জন দিতে পারে যে, সে-ই ইষ্টপ্রাণ। এরাই (যারা ইষ্টপ্রাণ) প্রকৃতভাবে পরমপিতাকে উপভোগ করতে পারে—এরাই প্রকৃত সুখের অধিকারী হয়।
কিন্তু যারা সংসারী নয় তাদের অন্যরূপ আদর্শ ৷ তারা তাদের পথ ধ’রে ঈশ্বরকে উপভোগ করছে। যারা সংসারী নয় তারা যদি ভাবে—ওরা (সংসারীরা) ঈশ্বরকে উপভোগ করতে পারে না, তারা ভুলই করে। সংসারে থেকে যদি নির্লিপ্ত থাকতে পারি, যদি তাঁকেই চলার পথের guide করতে পারি তাহলে আর ভাবনা কী?
এই যে পরমপিতাকে উপভোগ করার কথা বললাম—উপভোগ করার ফল কী দাড়ায়? তাঁকে উপভোগ করার ফল হ’ল complex-গুলো adjust (প্রবৃত্তিগুলো সুনিয়ন্ত্রণ) করা। ইষ্টের অনুশাসনবাদ মেনে চললে complex-গুলো adjusted (সুনিয়ন্ত্রিত) হয়।
নারায়ণদা (কর্মকার)—জ্ঞানী-যোগীও তো মনের ঘানিতে ঘোরে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—প্রকৃত জ্ঞানী হ’লে তা’ হয় না।
ননীদা (চক্রবর্তী)—গীতাতে পড়েছি জ্ঞান মানেই হ’ল ঈশ্বর-সম্বন্ধে প্রকৃত ধারণা—সবই ঐ এক ঈশ্বর। দুই বোধ হওয়াই অজ্ঞানতা।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ।
গুরুকিঙ্করদা—জ্ঞানলাভের প্রধান উপায় হচ্ছে ভক্তির পথ অবলম্বন করা। গীতায় আছে “নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য”—তাঁতে যুক্ত না হ’লে বুদ্ধিই হয় না।
পরমেশ্বরদা (পাল)—ভক্তরা মনে করেন তিনি (ঈশ্বর) সত্য, জীবও সত্য। কিন্তু জ্ঞানমার্গীরা একমাত্র তাঁকেই (ঈশ্বর) সত্য ব’লে স্বীকার করেন।
ননীদা—শঙ্করাচার্য্যও তো এই জগতের সত্যতা অস্বীকার করেছেন।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ব্রহ্ম নিত্য সত্য ব’লেই তো জীব সত্য। কেননা জীবকে সৃষ্টি করেছেন ব্রহ্ম।
ননীদা—ঠাকুর যা’ বলেছেন তার সাথে বৈষ্ণবদের মতবাদের বেশ মিল আছে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সব জিনিস নিয়েই মতদ্বৈত আছে। কেমনভাবে চলতে হবে ঠাকুর তা’ তো বলেই গেছেন। অযথা মতবাদের কচকচিতে না গিয়ে যাতে আমরা তাঁর পথে এগিয়ে চলতে পারি সবাইকে নিয়ে, তার জন্য সচেষ্ট থাকা লাগে। আর তা’তেই শান্তি।
[ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-২৬/৯/৭৪ ইং]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ২০৪ – ২০৫]