যাচ্ঞাকারীকে ফিরিও না। …ব্যাখ্যা

সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:

যাচ্ঞাকারীকে ফিরিও না। অর্থ, না হয় সহানুভূতি, সাহস, সান্ত্বনা, মিষ্টি কথা যা’ হয় একটা দাও—হৃদয় কোমল হবে।

পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :

আদেশক্রমে ছেলেদের মধ্যে প্রসূন আলোচনা করু করল।

প্রসূন—যে প্রার্থী, তাকে না ফেরানোর কথা এখানে ঠাকুর বলছেন। টাকা-পয়সা অথবা সহানুভূতি দেওয়ার কথা তিনি বলেছেন। সহানুভূতি মানে আমার কাছে একটা লোক এসেছে, তার দুঃখের কথা ব’লে কাঁদছে—তখন তার যেরকম কষ্ট হচ্ছে সেরকম বুঝে সাহায্য করলাম।—হয়তো আগুন লেগে বাড়ী পুড়ে গেছে, বলছে—কিছু টাকার দরকার; তখন আমি তাকে কিছু সাহায্য দিলাম।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—টাকা না চাইলে কী দেবে?

—তাহ’লে সহানুভূতি।

—কীরকম সহানুভূতি দেবে? কিছুই দিলে না, তখন সহানুভূতি আছে, কী দেখে বুঝব?

প্রশ্নটি তিনি পুনরায় আশিসকে করলেন।

আশিস—আমার কাছে হয়তো একটা লোক এল—তার বাবা মারা গেছেন। তার টাকা দরকার। সে টাকা চাইল। দুঃখ করতে লাগল। আমি বললাম—এরকম দুঃখ ক’রো না। এ সবারই হয়।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তাহলে টাকা দেবে না বল!

আশিস—টাকা আমার থাকলে দেব, না থাকলে শুধু সহানুভূতি জানাব।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তার মানে? টাকা তো আমাদের হাতে অনেক সময় থাকে না। তবু আমরা অনেক কাজ করি, শুভ কাজে এগিয়ে যাই। তুমি তার জন্য বাস্তবে কিছুই করলে না—সহানুভূতিই বা কেমন ক’রে দেখাবে?

ছেলেদের আলোচনায় বিষয়টি বেশ পরিস্ফুট হচ্ছে না দেখে শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—কেস্‌ তো একরকম না। কেউ হয়তো বলছে আমার ভাই মারা গেছে। হয়তো কেঁদে অস্থির। আমি বললাম, কাঁদছ কেন? চল দেখি। দেখে বললাম, না-না, কেঁদে ভেঙে পড় না, কত লোকের আরও কত জটিল অবস্থা হয়। তোমার কিছুই হয়নি। দেখা গেল প্রাণ তখনও আছে। ভাল ডাক্তার ডেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম, তারপর সে সুস্থ হ’ল।

খামাখা আগেই মানুষ ভয় করে—কী হ’ল রে বাবা!—ভেবেই অস্থির হয়ে পড়ল হয়ত। বড় বড় মানুষরাও এরকম ভয় করে থাকে কখনও কখনও।

যদি আশিস বলে প্রসূনের কাছে, ভাই, পিসিমার ভীষণ অসুখ, জ্বর, মাথায় যন্ত্রণা। তুমি (প্রসূন) তা’ শুনে বললে—এতে অত অস্থির হচ্ছ কেন? খুব জ্বর দেখে যত্ন করে মাথায় জল ঢেলে, জ্বর কমালে। এক অভিজ্ঞ ডাক্তার নিয়ে গেলে। প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে দিলে। এতে কী হ’ল? সাহস দেওয়া হ’ল, অর্থ দেওয়া হ’ল, সহানুভূতিও দেখানো হ’ল। ঠাকুর এভাবে অপরের সেবা দেওয়ার কথা বলেছেন। তাহ’লে কী হবে? হৃদয় কোমল হবে, মনের সংকীর্ণতা দূর হবে, সকলকে আপন মনে হবে। প্রশ্ন উঠল, ‘যা’ হয় একটা দাও’ —এখানে তো ঠাকুর যে কোনও একটা (অর্থ, সহানুভূতি, সাহস, সান্ত্বনা বা মিষ্টি কথা) জিনিস দেওয়ার কথা বলছেন।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সব কেস তো একরকম না। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা ক’রে যখন যা করার করতে হয়। কোন জায়গায় হয়ত অর্থ দিলেই সব সমস্যা মিটে যায়, আবার এমন অনেক জায়গা আছে অর্থ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যথোচিত সাহস বা সান্ত্বনা দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় কর্তব্য। আবার এমনও আছে যেখানে সাহস, সান্ত্বনা বা সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে বাস্তবে তুমি তার জন্য কিছু না করেই পার না। সাহস বা সহানুভূতি দেখানো তো শুধু মুখে মুখে হয় না! স্বতঃই যা করার তা হয়ে ওঠে। এসব তো লোক দেখানোর ব্যাপার নয়।

বাণীটির ব্যাখ্যা শেষ হলে শ্রীশ্রীপিতৃদেব ঐ বাণীটি পুনরায় মেয়েদের পাঠ করতে বললেন। প্রত্যেকে নিজ নিজ বই থেকে বাণীটি পাঠ করল। এরপর তিনি তাদের বই না দেখে বাণীটি বলতে বললেন। সকলে বই ঢেকে রেখে বাণীটি মুখস্থ বলল। শ্রীশ্রীপিতৃদেব খুশি হয়ে বললেন—এভাবে পড়তে হয়। মনে রাখতে হয়, চরিত্রগত করতে হয়। চরিত্রগত করা মানে? নিজের চরিত্রে ঐ ভাব ঢুকিয়ে দিতে হয়। চরিত্রে তা রূপায়িত করতে হয়। না হ’লে এমনি পাঠ ক’রে কী লাভ!

[ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তারিখ-২২/৬/৭৭ ইং ]

[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ১৭০ – ১৭১]