সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
যার উপর ক্রুদ্ধ হয়েছ, আগে তা’কে আলিঙ্গন কর, নিজ বাটীতে ভোজনের নিমন্ত্রণ কর, ডালা পাঠাও এবং হৃদয় খুলে বাক্যালাপ না-করা পর্য্যন্ত অনুতাপের সহিত তার মঙ্গলের জন্য পরমপিতার কাছে প্রার্থনা কর; কেন না, বিদ্বেষ এলেই ক্রমে তুমি সংকীৰ্ণ হ’য়ে প’ড়বে; আর, সংকীর্ণতাই পাপ ।
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীশ্রীপিতৃদেব অর্চনাকে (শ্রদ্ধেয় অমুল্যরতন রায়ের কন্যা) আলোচনা করতে বললেন।
অর্চনা—আমি যদি কারও উপর রেগে ঝগড়া করি—
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—রেগে ঝগড়া করি, আবার ঝগড়া ক’রে রাগ হয়—অত বলার কী দরকার? রাগ করি বললেই তো হয়।
অর্চনা—আমি যদি কারও উপর রাগ করি, তার সঙ্গে মনোমালিন্য হয় তখন তাকে আলিঙ্গন করব; বলব—ভাই আমারই দোষ, আমি ভুল করেছি, আমায় ক্ষমা কর—এই ব’লে গলা জড়িয়ে ধরব।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—গলা জড়িয়ে আলিঙ্গন করা যায়, আবার মনের আলিঙ্গনও আছে। তার উপর যখন আমি প্রীত হলাম, ক্রোধভাব চলে গেল, তখন মনের আলিঙ্গন হয়। আর ডালা পাঠাও মানে?
অর্চনা—মিষ্টি পাঠালাম।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—চাল, ডাল, তরি-তরকারি যা সব থেকে ভাল—ওর পছন্দমত জিনিস সাধ্যমত ওর কাছে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর কী আছে?
অর্চনা—’হৃদয় খুলে বাক্যালাপ না করা পর্যন্ত অনুতাপের সহিত পরমপিতার কাছে প্রার্থনা কর!’
শ্রীশ্রীপিতৃদেব— প্রার্থনা কী জন্য?
অর্চনা—ওর যাতে শান্তি হয়, মঙ্গল হয়।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ওর শান্তি, মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করতে হবে কেন?
অর্চনা—কেননা ওর ওপর আমার বিদ্বেষ এলেই ক্রমে আমি সংকীর্ণ হয়ে পড়ব।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সংকীর্ণ হওয়া মানে?
অর্চনা—মন ছোট হওয়া।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—মন ছোট বুঝব কী ক’রে?
অর্চনাকে নির্বাক থাকতে দেখে তিনি নিজেই বললেন—অপরের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের চিন্তায়, অপরের অমঙ্গল চিন্তায় নিজের মধ্যে সেগুলি জমা হয়। যেমন ধর—কাউকে একদিন পাটালি দিয়েছি, আজ একটু মনোমালিন্য হতেই বারে-বারে বলছি—আমার পাটালি ফেরৎ দিয়ে দে। অথচ ক’দিন আগে দিয়েছি, ক-বে তার খাওয়া হয়ে গেছে! এটা সংকীর্ণতা। কী হয় এতে?
অর্চনা—সংকীর্ণতাই পাপ।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ঠিক। তাহলে পুণ্য আছে, পুণ্য কী? না, প্রসারণই পুণ্য, বিস্তারই পুণ্য। মানুষ সংকীর্ণ হ’য়ে নিজের লোককেই পর ক’রে দেয়; আর বিস্তৃতি পরকে আপন করে।
পরমেশ্বরদা (পাল) প্রশ্ন তুললেন—ক্রোধ কি শত্রু?
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—বিস্তার নিয়ে কথা। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এগুলো আমাদের বিস্তারের ব্যাঘাত ঘটায়, তাই এদের রিপু বলে।
পরমেশ্বরদা—ক্রোধের প্রয়োজন আছে কি-না?
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—নিশ্চয়ই আছে। পরমপিতার সৃষ্টি সব জিনিসেরই utility (উপযোগিতা) আছে, তবে ব্যবহার জানা চাই। মন পরিষ্কার থাকা চাই। বামাক্ষ্যাপা শ্মশানে থাকতেন। অনেক লোক তাঁর কাছে আসত সাধনভজন শেখার জন্য। বামাক্ষ্যাপা অনেকক্ষেত্রেই চিতা থেকে জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে দৌড়ে এসে বলতেন—বিরক্ত করতে এসেছিস শালা?—এরকম কথা শুনে অনেকে ভয়ে চলে গেছে। কাঠিয়াবাবাজীর আশ্রমে একটা বাচ্চা ছেলে ডালিমপাতা নিতে এসেছে। তিনি তো আধঘন্টা ধরে ঝগড়া করলেন। ছেলেটা চলে যেতেই উপস্থিত শিষ্যদের সঙ্গে-সঙ্গে কচ্ছেন—‘ও আমার সঙ্গে ঝগড়ায় পারল না, না-রে?’ আমাদের মতন লোকের অপরের ওপর ক্রুদ্ধ হ’লে পর একটা ছাপ থাকে মনের মধ্যে, তার ক্রিয়া আমাদের বিস্তারের পক্ষে ক্ষতিকর; আর তাঁদের ক্ষেত্রে মনে কোন ছাপই পড়ে না।
পরমেশ্বরদা—স্বতঃঅনুজ্ঞায় রয়েছে—“আমি অক্রোধী , . .’
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ক্রোধ আমাদের বিদ্যমানতাকে নাশ করে, তাই ঠাকুর অক্রোধী হ’তে বলেছেন।
পরমেশ্বরদা—আমার সম্বন্ধে কেউ খারাপ কথা বলল, আমি সহ্য করে গেলাম। কিন্তু যদি অজিতদার সম্বন্ধে আমার কাছে কেউ খারাপ কথা বলে, তখন কি অক্রোধী হ’তে হবে?
এ-প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—ঠাকুরের কি বলা আছে যেন—তোমার শ্রেয় বা প্রেয়ের অমর্যাদাকর ব্যাপারে তুমি যদি প্রচণ্ড তৎপরতায় অমর্যাদাকারীকে দলনদীর্ণ ক’রে না তুলতে পারলে তোমার শ্রেয়-প্রেয়-আনতি ক্লীব তো বটেই।
ননীদা—আজ্ঞে, ‘জীবন-দীপ্তি’ (২য় খণ্ড)-তে ও-কথা আছে।
অতঃপর শ্রীশ্রীপিতৃদেব এক গল্পের অবতারণা করলেন—শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গল্পে আছে, একবার নারদ এক সাপকে দীক্ষা দিয়ে বলেছিলেন—ক্রোধ করো না। সাপটি তখন থেকে কারও ওপর ক্রোধ করত না। তারপর থেকে ছেলেপুলে সবাই তার দিকে ইট-পাথর ছুঁড়ত। ফলে তার অবস্থা সঙ্গীন হয়ে গেল। গর্তের বাইরে আসতে পারে না। দিন-দিন ক্ষীণকায় হতে থাকল। একদিন নারদ এ স্থান দিয়ে যেতে-যেতে ঐ সাপটির খোঁজ করলেন। খুঁজতে-খুঁজতে ক্ষীণকায় অবস্থায় এ সাপটিকে দেখে বললেন—তোমার এ অবস্থা হ’ল কেন? সাপটি বলল—আপনি তো ক্রোধ করতে নিষেধ করেছেন, তাই যে পারে সে-ই ঢিল ছোঁড়ে। নারদ তা শুনে বললেন—তোমায় ক্রোধ করতে নিষেধ করেছি, কিন্তু ফোঁস করতে তো নিষেধ করিনি।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব আরো বললেন—তোমার সামনে একটা গরু তেড়ে আসছে, সেখানে তুমি যদি তার হাত থেকে রক্ষার জন্য লাঠি নিয়ে না তেড়ে যাও, তুমি কি করে রক্ষা পাবে? এ ক্রোধ কিন্তু হওয়া চাই বিকারশূন্য ক্রোধ।
[ ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-২৭/১/৭৬ ইং]
ভবানীদা (রায়) আলোচনা করার নির্দেশ পেয়ে বললেন—শ্রীশ্রীঠাকুর এখানে বলছেন, যার উপর আমার ক্রোধ হয়েছে, যার ব্যবহারে আমি অসন্তুষ্ট হয়েছি—তার সঙ্গে যাতে আমি হৃদয় বিনিময় করি। তা কেমন করে করা যায় সেটা এখানে বলছেন—নিজ বাটীতে তাকে নিমন্ত্রণ ক’রে খাইয়ে, যে সব জিনিস ভালবাসে সেগুলি পাঠিয়ে। যেমন বন্ধুত্ব ছিল সেভাবে কথা বলে, আর যতদিন এ-রকম না হয় ততদিন পরমপিতার কাছে প্রার্থনা করব।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—’যতদিন’ পর্যন্ত হলে দীর্ঘদিন হয়, ‘যতক্ষণ’ হলে হয়। যত কম সময়ে হয় তত ভাল। মন খুলে কথা বলতে হবে। আমার বাড়িতে যদি খাওয়ার ব্যবস্থা না হয় তাহলে ডালা পাঠাতে হবে। যতদিন করলে হবে না—যতক্ষণ।
ভবানীদা—আজ্ঞে, আমার একবার হয়েছিল। ঠাকুরের এখানে দাঁড়িয়ে, অজিতদা (গাঙ্গুলী) একটা ব্যাপারে কার কাছে ভুল information (সংবাদ) পেয়েছেন। আমাকে ঝাড়লেন। দাঁড়িয়ে আছি—চোখে জল আসছে। আবার যে ভুল বলেছে সে স্বীকারও করছে না। পরের দিন অজিতদা আমাকে নিমন্ত্রণ করে খাইয়ে দিলেন।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, সেই রকম।
[পিতৃদেবের চরণপ্রান্তে/তাং-১/৭/৭৯ ইং]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ৮৫, ৮৬]