সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
যেখানে গমন ক’রলে মনের গ্রন্থির মোচন বা সমাধান হয়—তাই তীর্থ।
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীশ্রীপিতৃদেব বেণুকে আলোচনা করার আদেশ দিলেন।
বেণুকে বাণীটি পুনরায় পাঠ করে নির্বাক থাকতে দেখে তিনি দীপ্তিকে আলোচনা করার কথা বললেন।দীপ্তি আবার বাণীটি পাঠ করল।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—কয়েকটা তীর্থের নাম কর।
দীপ্তি—গয়া, কাশী, বৃন্দাবন।
—দেওঘর তীর্থ না! কত লোকে দেওঘর আসে। তাহলে তীর্থ কাকে বলে?
দীপ্তি—যেখানে গমন করিলে মনের গ্রন্থির সমাধান হয়।
—মনের গ্রন্থি মানে কী? গ্রন্থি কাকে বলে?
দীপ্তিকে নিরুত্তর দেখে তিনি বেণুকে জিজ্ঞাসা করলেন। বেণুও কোন উত্তর না দেওয়ায় তিনি নবানীকে এ প্রশ্ন করলেন।
নবানী—মনের কুসংস্কার।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, তা-তো হয়ই। তবে গ্রন্থি মানে গিঁট। (নিজের পরিহিত চাদরে গিঁট বেঁধে) এই দেখ, গ্রন্থি মানে গিঁট। আর গ্রন্থ মানে?
—বই।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব পুনরায় দীপ্তিকে একই প্রশ্ন করলেন। দীপ্তি ঠিক-ঠিক উত্তর করল। এরপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন (নবানীকে) মনের গ্রন্থি মানে কী—বল।
নবানী—মনের গ্রন্থি মানে মনের গিঁট।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—এরপর বল, মোচন মানে কি?
উত্তর না পেয়ে তিনি বললেন—মোচন জান না! মোচন মানে খোলা।
তাহলে বল মনের গিট কোন্গুলো, আর কেমন ক’রে তাদের মোচন হয়?
ছোটরা কেউ ঠিকমত উত্তর দিতে পারছে না দেখে ননীদা (চক্রবর্তী) উত্তর দিলেন—মনের মধ্যে আমাদের অনেক রকমের কুসংস্কার থাকে, সেগুলো দূর করতে হয়। নানান ভাবে সেগুলো দূর করা যায়।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব সম্মতি জানিয়ে বললেন—কুসংস্কার আবার ছোটখাটো হতে পারে, বড়ও হ’তে পারে। ছোটখাট—যেমন আমি বামুন, শূদ্রের কাছে গেলে জাত যায়, বৈশ্যর সঙ্গে বসা যায় না, নিজে বড়—এমন ভাব। এরকম নানাপ্রকারের হ’তে পারে মনে হয়—মনে হয় এসবই গ্রন্থি।
যে যা, সে সেই নিয়েই বড়। আমাদের প্রত্যেকের নিজ-নিজ বৈশিষ্ট্য আছে। প্রত্যেকেই স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যবান।
আমরা ঠাকুরের প্রসাদ নিই, সবাই একসাথে বসেই। তখন সকলকে আপন মনে হয়, ভাই-ভাই মনে হয়। সকলকে আপন মনে না হওয়াটাই মনের গ্রন্থি। সবাই একসঙ্গে প্রার্থনা করলাম, ঠাকুরের প্রসাদ পেলাম, এক প্যান্ডেলে থাকলাম জাতি-বর্ণ-নির্বশেষে, কাউকে ছোট মনে করলাম না—এতেই বোঝা যায় মনের মধ্যে ছোট-বড় নিয়ে ভেদ নেই, কোনরকম গিঁট নেই।
সকলকে ভালবাসা, সকলের দুঃখে দুঃখী হওয়া, সকলের ব্যথায় ব্যথী হওয়া—এই-ই তো গ্রন্থিমোচন! কেউ-কেউ এমন আছে তার বাড়ীতে অন্য বর্ণের কেউ ঢুকলেই ভাবে বুঝি জাত গেল! এরকম সংকীর্ণতার জন্যই মানুষ শান্তি পায় না।
[ ইষ্ট-প্রসঙ্গে/ তাং-১/১২/৭৬ ইং ]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ৩২৪ – ৩২৫]