যেখানে দেখবে, কেউ বিশ্বাসের …. বেরুচ্ছে।-ব্যাখ্যা

সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:

যেখানে দেখবে, কেউ বিশ্বাসের গর্ব্বের সহিত সত্যের বিষয় ব’লছে, দয়ার কথা ব’লতে-ব’লতে আনন্দে এবং দীনতায় অধীর হ’য়ে প’ড়ছে, প্রেমের সহিত আবেগভরে সব্বাইকে ডাকছে, আলিঙ্গন ক’রছে, আর যে-মুহূর্ত্তে তার মহত্ত্বের কথা কেউ ব’লছে, তা’ স্বীকার ক’রছে না, বরং দীন এবং ম্লান হ’য়ে বুকভাঙ্গা মত হ’য়ে প’ড়ছে—খুবই ঠিক, তার কাছে উজ্জ্বল সত্য আছেই আছে; আর, তার সাধারণ চরিত্রেও দেখতে পাবে, সত্য ফুটে বেরুচ্ছে।

পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :

প্রশ্ন করলেন হরিপদদা (দাস) (সতীশদাকে)—বিশ্বাসের গর্বের সহিত সত্যের বিষয় বলতে কী বুঝব?

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—বিশ্বাসের গর্ব পরে হবে। সত্য কী? সত্য বলতে ঠাকুর কী বোঝাচ্ছেন, সেটা হোক আগে। হরিপদদা আবার বাণীটি পড়লেন।

শ্রীশ্রীপিতৃদেবের ঐ একই প্রশ্ন—সত্য কী?

হরিপদদা—যখন কেউ শুধু তার ইষ্টকে নিয়েই থাকে তখন তার আচারে ব্যবহারে ঐ ভাব (ইষ্টের ভাব) ফুটে বেরোয়। তখন তাকে দেখেই তার ইষ্টকে বোঝা যায়। তখনই বুঝতে হবে তার মধ্যে সত্য আছেই। উজ্জ্বল সত্য মানে সত্য উজ্জ্বল হয়ে ফুটে বেরুচ্ছে।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তার কাছে উজ্জ্বল সত্য আছে এবং তা’ ফুটে বেরুচ্ছে বলতে কী বুঝব?

বঙ্কিমদা (মণ্ডল)—তার মানে এক জনের প্রশংসা যখন কেউ করছে, তখন সে (যার প্রশংসা করা হচ্ছে) সংকুচিত হ’য়ে পড়ছে—এ-রকম হ’লে বুঝতে হবে যার প্রশংসা করা হচ্ছে তার মধ্যে উজ্জ্বল সত্য আছেই।

আলোচনা চলতে-চলতে ননীদা (চক্রবর্তী) এসে বসলেন। শ্রীশ্রীপিতৃদেব সম্মুখস্থ দাদাদের আবার প্রশ্ন করলেন—উজ্জ্বল সত্যটা কী?

বঙ্কিমদা (মণ্ডল)—যিনি মঙ্গলময় তাঁর প্রতি ভক্তের ভক্তি, নিষ্ঠা ইত্যাদির প্রকাশ—এটাই উজ্জ্বল সত্য।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—উজ্জ্বল সত্য থাকলেই তো ও-সব ভক্তি-নিষ্ঠা থাকে। তাহ’লে উজ্জ্বল সত্য কী?

বঙ্কিমদা—ইষ্ট মঙ্গলময়-—এই বোধই উজ্জ্বল সত্য।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—এটা কী ক’রে ফুটে বেরুবে?

বঙ্কিমদা—ইষ্টের ভাবে তটস্থ হ’য়ে থাকলে তখন সেটা আচারে-ব্যবহারে ফুটে বেরোয়।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তটস্থ মানে কী? তটস্থ মানে কি সন্ত্রস্ত হ’য়ে থাকা? হয়তো গাছে উঠেছি। মনে হচ্ছে এই প’ড়ে গেলাম, এই প’ড়ে গেলাম—এ-রকম ভাব?

শ্ৰীশ্রীপিতৃদেবের কথা শুনে উপস্থিত সকলে মৃদু হেসে উঠলেন।

পণ্ডিতদা—আজ্ঞে, না। সে-রকম না। কিশোরীদা (দাস) যেমন ঠাকুরের কথা বলতে-বলতে বাহ্যজ্ঞান শূন্য হ’য়ে পড়তেন। তখন শুধু তাঁর মুখ থেকে শোনা যেত—’এই সেই’ ‘এই সেই’।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব পন্ডিতদার কথায় সম্মতি জানিয়ে বললেন—হ্যাঁ, এখানে সম্মানসূচক কথা বলা হচ্ছে না। ‘ইনি তিনি’ এ-কথা নয়। ‘এই সেই’—এ-কথার মধ্যে কত মহান সম্মান, কত গভীর বিশ্বাস…..

পণ্ডিতদা—কিশোরীদার রকমই ছিল, Think not for words but for fact and thought.

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ঠাকুরের কথা উঠলেই কিশোরীকাকা দু’এক মিনিট ব’লেই আর বলতে পারতেন না। চোখ-মুখের ভাবই বদলে যেত। উপস্থিত সকলেও তখন সে’ভাবে ভাবিত হ’ত।

কথা ব’লতে-ব’লতে পিতৃদেবের চোখ-মুখ ভাব-গম্ভীর হয়ে এল। সবাই নির্বাক।

বঙ্কিমদা আবার প্রশ্ন করলেন—তাহ’লে উজ্জ্বল সত্য হচ্ছে তাঁর প্রতি বিশ্বাস?

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ইষ্টের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসটাই সত্য, উজ্জ্বল? তিনি সত্য না হ’য়ে তাঁর প্রতি বিশ্বাসটাই সত্য? তিনি আছেন ব’লেই তো তাঁর প্রতি বিশ্বাস।

ননীদা—তিনি আছেন, এটাই সত্য।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—’এই সেই’, ‘এই সেই’—যার মধ্যে এ বোধ আছে, তার কাছে উজ্জ্বল সত্য আছে আর তা’ ফুটে বেরুচ্ছে। যে তাঁকে (ইষ্টকে) এভাবে বিশ্বাস করে, তাঁর আর যা’-যা’ গুণ, সে সেই-সেই গুণে ভূষিত হয়। তার প্রেম, তার ভালবাসা, তার বিনয়, এগুলো তাঁরই (ইষ্টের) আলো। এগুলো আবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। যেমন, সূর্য আর সূর্যের আলো। সূর্যেরই আলো। কিন্তু আলো বাদ দিয়ে সূর্য হয় না। ঠিক ও-রকম।

পণ্ডিতদা—বিরাটকে প্রকাশ করতে গেলে সে নিজেও (যে প্রকাশ করতে চায়) প্রকাশিত হয়।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ। সেই আলো তাঁরই আলো। বিনয়, দীনতা, বিশ্বাস, ভক্তি, প্রেম—সব তাঁরই প্রকাশ। আমি তো ও-রকম বুঝি। তাঁকে বাদ দিয়ে ওগুলোর কিছু মানে হবে না। ওগুলো clear-ই (পরিষ্কারই) হবে না।

‘এই সেই’, ‘এই সেই’। ‘ইনি তিনি’—নয়। এর চেয়ে আর বিশ্বাস নেই। আর এই বোধ যার মধ্যে জাগ্রত তার শরীরে এ- ভাবের প্রকাশ হয় চোখ দিয়ে, মুখ দিয়ে। শুধু প্রকাশই হয় না, তার ভাব শ্রোতাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। তখন তার প্রেমময়ী ভাষণে সবাই প্রেমিক হ’য়ে ওঠে। জ্বালাময়ী ভাষণ যেমন মানুষকে উত্তেজিত ক’রে তোলে সে’রূপ বিশ্বাসীর প্রেমময়ী ভাষণ মানুষকে প্রেমিক ক’রে তোলে।

[ ইষ্ট-প্ৰসঙ্গে/তাং-১০/১১/৭৪ ইং]

[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ২৬১-২৬২]