সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
যে আগে ঝাঁপ দিয়েছে, আগে পথ দেখিয়েছে, সেই নেতা ; নতুবা শুধু কথায় কি নেতা হওয়া যায়?
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীশ্রীপিতৃদেব দিলীপকে (চক্রবর্তী) আলোচনা করতে নির্দেশ দিলেন।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব সূত্রটি ধরিয়ে দিলেন—’আগে ঝাঁপ দিয়েছে’, ‘আগে পথ দেখিয়েছে’ আলোচনা করা দরকার তো! আগে ঝাঁপ দিয়েছে কিসে? কোথায় ঝাঁপটা দিল?
দিলীপ কিছু বলল। শ্রীশ্রীপিতৃদেব একটা উদাহরণ দিতে বললেন।
দিলীপ ইষ্টের কাজে ঝাঁপ দেওয়া উদাহরণ দিচ্ছিল। সেই সূত্র ধরে শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন— ইষ্টের কাজে ঝাঁপ দিল মানে কী? মানে ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করল। সে বুঝেছে এই কাজে দেশের দশের কল্যাণ হবে, মঙ্গল হবে—সর্বকল্যাণকর কাজ। এই কাজই সর্বোৎকৃষ্ট।
ঝাঁপ দেওয়া কথাটা এল কি করে? লোকে জলে ঝাঁপ দেয়। অথৈ জল, তাতে ঝাঁপ দিল। সেখানে ঝাঁপ দিতে গেলে সাঁতার ভালভাবে জানতে হয়। জলের মধ্যে তো হাঁটা যায় না। তাই সাঁতার শিখতে হয়। জলকে আশ্রয় করে থাকতে হয়। ইষ্টকাজে ঝাঁপ দিলে ইষ্টকে আশ্রয় করে চলতে হয়। পিছনের দিকে আর খেয়াল থাকে না। বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করেই ঝাঁপ দেয়। ইষ্টকাজে যারা ঝাঁপ দিচ্ছে তারা ঘর-সংসার সব তুচ্ছ করে ঝাঁপ দেয়। ইষ্টকাজকে যে মুখ্য করে সে ইষ্টকে ভালবাসে। ইষ্টকে ভালবাসলে সবাইকে ভালবাসবে। সকলের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক তৈরি হয়।
আবার ইষ্ট কী চান,—নিজের চলা, বলা, করা সেই মাফিক নিয়ন্ত্রণ করে চলবে। তা ভিন্ন ইষ্টকাজ করব বলছি, আর সকলের সাথে তর্কাতর্কি, ঝগড়া-ঝাঁটি হতে থাকবে। যে ইষ্টকাজে ঝাঁপ দেয় তার সহ্য-ধৈর্য্যও বেশি। অথৈ জলে যে ঝাঁপ দেয় সে সাঁতার জানে, কোন্ অবস্থায় কিভাবে সাঁতার দিতে হবে, কিভাবে সামনে এগিয়ে যেতে হবে সে জানে। জলের সাথে প্রীতির সম্পর্ক হলে তা সম্ভব। প্রীতির বন্ধন যখন হয় তখন ঝাঁপ দিতে পারে। যে ব্যক্তি ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠায় ঝাঁপ দিচ্ছে সে হয়ত আগে বড় চাকরি, কিংবা ভাল ব্যবসা করত। তারপর যখন এইকাজে ঝাঁপ দিল তখন তো মাসে মাসে হাতে টাকা আসে না; তথাপি তার কিছু মনেই হচ্ছে না, হয়ত একবেলা না খেয়েই কেটে গেল—মহৎ কাজ করতে গিয়ে এই অবস্থাও তার কাছে পরম তৃপ্তির।
দেশ তখন বৃটিশের অধীন। স্বাধীনতা আন্দোলনে কত বড় বড় মানুষ দেশের কাজে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের তখনকার মাসে চল্লিশ হাজার টাকা আয়। সেই আয় ছেড়ে দিয়ে তিনি দেশের কাজে ব্রতী হলেন। দেশের মানুষের উপর নির্ভর করে চলতে থাকেন। ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার কাজে ঝাঁপ দিতে গেলে ইষ্টের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বুঝতে হবে। তিনি যা চান সেই মাফিক নিজেকে তৈরি করে অগ্রসর হতে হবে। ইষ্টের দয়ার উপর নির্ভর করতে হবে।
কোন ব্যক্তি যখন প্রথমে ঝাঁপ দেয় তাকে দেখে লোকে অনুভব করে তাহলে এমনি করে ঝাঁপ দেওয়া যায়। সে তখন উদাহরণ হয়, তাকে সবাই শ্রদ্ধা করে, সমীহ করে। পিছনে যারা আসছে তাদের নিয়ে যায় তাই সে নেতা। পিছনের লোকেরা তার অনুসরণ করে। দেশবন্ধু আয়-উপার্জন ছেড়ে দিলেন, নিজের বাড়ি-সম্পত্তি সব দেশের জন্য দিয়ে দিলেন। তা দেখে বহু যুবক দেশের কাজে ঝাঁপ দিয়েছে, স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে। তাই দেশবন্ধু নেতা। তেমনি সবক্ষেত্রেই এরকম উদাহরণ দেওয়া যায়।
[ ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-২৩/৮/৭৬ ইং ]
শ্রীকন্ঠদা—কোন নীতির দ্বারা নীত হ’লে হবে না—কোন জীবন্ত আদর্শের কাছে নীত হ’তে হবে।আগে নীত না হ’লে নিয়ে যাবে কি ক’রে?
শ্রীশ্রীবড়দা—’নী’ মানে প্রাপন।
সতীশদা—পাওয়ানোর জন্য যে নিয়ে যাচ্ছে।
অমূল্যদা—যারা নেতা তারা আদর্শ পুরুষকে নিয়ে যান।
পণ্ডিতদা—পথ না পেলে আর একজনকে নেবে কি করে?
ব্ৰজ গুরুদা—আগে ঝাঁপ দিয়েছে মানে নিজে surrender করেছে, তারপর নিয়ে যাচ্ছে।
শ্রীশ্রীবড়দা—নিজে ঠিক ম’তো না হ’য়ে উঠলে নিয়ে যাবে কি ক’রে?
ননীদা—ঝাঁপ দেবে কোথায়? আদর্শে।
হরিপদদা—আগে না গেলে পথ দেখাবে কি ক’রে?
শ্রীশ্রীবড়দা—জলে ঝাপ দিল। সে কি ডুবে মরবার জন্য দিল?
হরিপদদা—না।
শ্রীশ্রীবড়দা—তবে?
হরিপদদা—সাঁতার জানা আছে নিশ্চয়ই।
শ্রীশ্রীবড়দা—হ্যাঁ, আগে সাঁতার শেখে, তারপর ঝাঁপ দেয়।
পরেশ—আজকাল নেতা কি তেমন আছে?
শ্রীশ্রীবড়দা—তোমার কতখানা বই পড়া আছে? নেতাজী, মা-বাপের ধর্ম্ম পালন ক’রতেন—ধর্ম্মের ওপর সাংঘাতিক বিশ্বাস ছিল। বিবেকানন্দের বই প’ড়ে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করলেন। সি. আর. দাশকে মাথায় নিয়ে চলেছিলেন। কোহিমায় যখন এসেছেন, ওঁর (নেতাজীর) মার কাছে কেউ যেয়ে বলল—এদেশে এসেছে, দেশের রাজা হবে। ওঁর মা তখন বললেন— “ও কথা মোটেই মনে আনতে নেই। এদেশে এলে সে একজন সাধারণ সেবক হবে।”
[‘যামিনীকান্ত রায়চৌধুরীর দিনলিপি/তাং-০১/৪/৭৫ ইং]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ২৪৬ – ২৪৮]