শিষ্যের কৰ্ত্তব্য প্রাণপণে … চলা। – ব্যাখ্যা

সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:

শিষ্যের কৰ্ত্তব্য প্রাণপণে গুরুর আদেশ কার্য্যে পরিণত করা, গুরুকে লক্ষ্য ক’রে চলা।

পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :

পাঠ শেষে শ্রীশ্রীপিতৃদেব ধৃতিদীপীকে বাণীটি আলোচনা করতে আদেশ দিলেন।

ধৃতিদীপী—গুরু যা’ বলেন মুখে না ব’লে তা’ কাজে করতে হবে। এটাই হ’ল শিষ্যের কর্তব্য। যেমন, শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন—
“মাছ-মাংস খাসনে আর
পিঁয়াজ-রসুন মাদক ছাড়”;
কেউ হয়ত এসব ব’লে বেড়াচ্ছে, কিন্তু লুকিয়ে মাছ খায়—এরকম করা ঠিক নয়। ঠাকুর এরকম না করার কথা বলেছেন।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—নাম-ধ্যানের বিষয়ে ঠাকুর কী বলেছেন?—উষা-নিশায় কী করার কথা বলেছেন?

ধৃতিদীপী—
“ঊষা-নিশায় মন্ত্রসাধন
চলা-ফেরায় জপ
যথাসময় ইষ্টনিদেশ
মূর্ত্ত করাই তপ।”
ঊষা-নিশায় মন্ত্রসাধন করার কথা শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন। আর চলা-ফেরায় জপ করার কথা বলেছেন।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ঊষা-নিশা মানে?

ধৃতিদীপী—সকাল-সন্ধ্যা।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ঊষাকাল মানে ভোরবেলা। পাখী জেগেছে কিন্তু বাসা ছাড়েনি—সে’সময়কে বলে ঊষা। আর এরও পূর্বের সময় নিশাকাল। ঠাকুর যেরকম বলেছেন ঠিক সে’ভাবেই আমাদের নাম-ধ্যান করা উচিত।. . . আর ‘প্রাণপণে’ কথার অর্থ?

ধৃতিদীপী—আর কারো কথা না শুনে গুরুর কথা মেনে চলা।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—প্রাণপণে মানে কি তাই? প্রাণপণে মানে প্রাণকে পণ রেখে। যায় প্রাণ যাক্‌—এইভাব অন্তরে রেখে গুরুর আদেশ পালন করা। সেই আরুণির গল্পটা কী যেন?

সৎসঙ্গ সম্পাদক ননী’দা আরুণির গুরুর আদেশ পালনের কাহিনী ব্যক্ত করলেন—গুরু আরুণিকে জমির আল বাঁধতে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু জলের বেগ কিছুতেই রোধ করতে না পেরে নিরুপায় হয়ে আরুণি নিজে শেষ পর্যন্ত আলের মুখে শুয়ে পড়লেন। এদিকে রাত হয়—আরুণি আর ফেরেনা। পরে গুরু ঘটনাস্থলে গিয়ে আরুণির নিষ্ঠা দেখে সবিশেষ প্রীত হলেন।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব সাগ্রহে প্রশ্ন করলেন—আর উপমন্যুর ঘটনা কী যেন?

কিভাবে গুরুর আদেশ পালন করে অন্ধ হ’য়েও উপমন্যুর গুরুগত প্রাণের পরিচয় পাওয়া যায়—সে কাহিনী ননীদা সবিস্তারে ব্যক্ত করলেন।

প্ৰসঙ্গক্ৰমে শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—গুরুর আদেশ পালন করতে গিয়ে অনেক কৃচ্ছতা বরণ করতে হ’ল উপমন্যুকে। শেষ পৰ্যন্ত গুরু খুশি হয়ে তাকে ব্রহ্মজ্ঞান দান করলেন। গুরু খুশি হলে শত বাধার মধ্যেও এভাবে চরম সিদ্ধি আসে।. . . আরুণি, উপমন্যুর এসব ঘটনায় আমরা গুরুভক্তির উজ্জ্বল নিদর্শন পাই।

[ ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-১৬/৩/৭৬ ইং ]

তপোবিভূতি চৌধুরী আলোচনার নির্দেশ পেয়ে আর একবার পাঠ করে বলল—যাঁর অনুশাসনবাদ মেনে চলার জন্য দীক্ষা নিই—তিনি গুরু। দীক্ষা মানে দক্ষতা অর্জন করা। এই দক্ষতা অর্জন করার জন্য তাঁর অনুশাসনবাদ প্রাণপণে মেনে চলব।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, তাঁর অনুশাসনবাদ যদি মেনে না চলি তাহলে কার্য্যে পরিণতই বা করব কেমন করে, দক্ষই বা হব কেমন করে? ঠাকুরের অনুশাসনবাদ মেনে চরিত্র গঠন করব, দক্ষ হয়ে উঠব, তাতে ঈশ্বরকে পাওয়ার পথ খুলে যাবে।

পরে মিনতিকে বললেন আবার আলোচনা করার জন্য। মিনতি বাণীটি পড়ে বলল—গুরুর আদেশ প্রাণপণে মেনে চলতে হবে।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—কেন? প্রাণপণে মেনে চলতে হবে কেন? (একটু পর) দীক্ষা নিয়ে শিষ্য হয়েছি তো। প্রাণপণে তাঁর আদেশ পালন করার জন্যই দীক্ষা নিয়েছি। (অন্নদা-দাকে) তুই কিছু বল্‌।

অন্নদা-দা (মাজী)—যেমন, আলো থাকলে সেদিকে লক্ষ্য করে চলি, তেমনি তাঁকে লক্ষ্য করে চলতে হবে।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—লক্ষ্য করে কি চলতে হবে?—তাঁর অনুশাসনবাদ মেনে চলতে হবে।

—আজ্ঞে ।

[পিতৃদেবের চরণপ্রান্তে/তাং-২৭/৮/৭৯ ইং]

প্রশ্ন হল—অনুকরণ করা, না অনুসরণ করা।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন গুরুকে লক্ষ্য করে চলা। এর মানে কি এই হয়, গুরুর ছবি সামনে রেখে খেয়াল খুশি মত চলা? আদর্শকে অর্থাৎ ইষ্টের অনুশাসনবাদকে মেনে চলা। গুরু গ্রহণ করেছি যখন, তখন জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে তো! সেই উদ্দেশ্য যাতে পরিপূরণ হয় সেই ভাবে চলা। তার মানে যদি পরব্রহ্ম লাভ হয়, তবে তাই!

শ্ৰীশ্রীপিতৃদেব পশ্চিমদিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন ঐদিকে যে পাহাড় আছে ডিগরিয়া, আমার যদি উদ্দেশ্য হয় যাওয়ার, তবে যেভাবে যাওয়া যায় সেইভাবে গেলাম কিংবা নিজেই নতুন রাস্তা করে সিধে চলে গেলাম। তাতে নদী-নালা যেভাবে পার হতে হয় তাই করলাম। কাঁটার জংগলের মধ্য দিয়ে ঐ পাহাড়ে উঠলাম। হয়তো আমার জন্যই নতুন রাস্তা তৈরি হয়ে গেল। ভক্তদের জীবনে এই রকম হয়ে থাকে।

উক্ত দাদা—এভাবে গেলে ভীষণ কষ্ট!

শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—ভগবান লাভ বল আর পরমার্থ লাভ বল, এমনি এমনি হয়ে যায়? কষ্ট আছেই জীবনে। Life is not a bed of roses—ইংরাজী একটা কথা আছে। দেখ গে প্রহ্লাদের জীবন, ধ্রুবর জীবন; ঐ শিশুদের জীবনে কি কষ্ট। কি ভাবে শত বাধা-বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও একনিষ্ঠ হয়ে ভগবানের পথে চলেছেন। ভগবানের পথে চলতে গেলে বাধা থাকেই, তাকে অতিক্রম করতে হয়। এমন ভক্তজীবনের বহু দৃষ্টান্ত আছে পুরাণে।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—গুরু ধরেছে কে? আমি তো! আমি অর্থাৎ শিষ্য। শিষ্যের কর্তব্য কি? গুরুর আদেশ বাস্তবে রূপ দেওয়া বা ফুটিয়ে তোলা। তা কি ভাবে করতে হবে—প্রাণপণে। প্রাণপণের অর্থ অভিধান দেখে বললেন—’আবশ্যক হলে জীবন দিয়াও কার্যসিদ্ধি করিবার সংকল্প’।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—কি, বোঝা গেল?

উক্ত দাদা—আজ্ঞে, হ্যাঁ।

[ তাঁর সান্নিধ্যে/তাং-১৬/১২/৭৪ ইং]