সত্যানুসরণ -এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
“সদগুরুকে পরীক্ষা ক’রতে হ’লে তাঁর নিকট সঙ্কীর্ণ-সংস্কারবিহীন হ’য়ে, ভালবাসার হৃদয় নিয়ে, দীন এবং যতদূর সম্ভব নিরহঙ্কার হ’য়ে যেতে পারলে তাঁর দয়ায় সন্তুষ্ট হওয়া যেতে পারে।“
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীশ্রীপিতৃদেব ধৃতিদীপীকে বললেন, সঙ্কীর্ণ সংস্কারবিহীন এর অর্থ ভালভাবে বুঝিয়ে দাও।
ধৃতিদীপী—সংস্কার মানে যা পূর্বপুরুষ থেকে হয়ে আসছে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ঘর সংস্কার, গ্রাম সংস্কার মানে কী?
ধৃতিদীপী—ঘর সংস্কার মানে ঘরের উন্নতি, গ্রাম সংস্কার মানে গ্রামের উন্নতি।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—বাণীটা বুঝিয়ে দাও।
ধৃতিদীপীকে নিরুত্তর দেখে শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—সংস্কারে ভাল হয়। কিন্তু সঙ্কীর্ণ সংস্কারে মন ছোট হয়, জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসে না। যা করলে জীবনের ভাল হয়, উন্নতি হয়, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করা যায় তা-ই তো করতে হবে। যেমন ভোরবেলা ওঠা, ভোরে উঠে নামধ্যান করা, ইষ্টভৃতি করা, প্রার্থনা করা—এতে শরীর ভাল থাকে, মন ভাল থাকে, শরীর রোগমুক্ত হয়।
সঙ্কীর্ণ সংস্কার মানে যে সংস্কারে মন ছোট হয়। সাধুসন্তদের কাছে গেলে মনের বিস্তার হয়। সাধুদর্শনে গেলাম আমি আর অজিত (গাঙ্গুলী)। অজিত ভাল লোক, ভক্তি শ্রদ্ধা আছে, বিনয় আছে, ভক্তিভরে প্রণাম করল; আর আমি গ্যাঁট হ’য়ে দাঁড়ায়ে থাকলাম। ভাবছি, আমি কম কিসে। কত লোককে প্রেমের কথা ভালবাসার কথা বলছেন আমার সেদিকে মন নেই। আমার শ্রদ্ধাবোধ নেই, হাতে ক’রে কিছু নিয়েও যাইনি। প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হলাম। যা মনের মধ্যে সঙ্কীর্ণতা নিয়ে আসে তা পরিহার করতে হয়। যদি আমার মনে ভাব থাকে আমি এম-এ পাশ, প্রফেসার, আমি বিরাট কিছু, আমার সমান আর কে আছে, তাহ’লে তাঁর প্রসাদ লাভ হবে না। শ্রদ্ধা, ভক্তি, দীনতা, বিনয় এগুলো নিয়ে প্রেমী সাধুগুরুর কাছে যেতে হবে।
বালকদের দিকে তাকিয়ে শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—বুঝতে পেরেছ?
বালকগণ—আজ্ঞে।
শংকরদা (রায়) গতকালের বাণীটি ফিস্-ফিস্ ক’রে পড়ছেন। শ্রীশ্রীপিতৃদেব তাকে বললেন, গতকালের বাণীর সঙ্গে এই বাণীর link (যোগ) ক’রে দে দেখি।
শংকরদা—আমি যখন কোনও প্রেমী সাধুগুরুর কাছে যাব তখন সঙ্কীর্ণ সংস্কার বর্জিত হয়ে যাব।
—বল্, যখন সাধুদর্শনে যাব তখন সঙ্কীর্ণ সংস্কার মুক্ত হয়ে যাব। সাধুদর্শনের সময় সঙ্কীর্ণ সংস্কার কী থাকতে পারে?
পরমেশ্বরদা (পাল)—সাধু বলতে অনেকে ধারণা করে থাকে বিরাট জটা থাকবে।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, সাধু বলতে অনেকের এইরকম ধারণা আছে। যোগীরাজ শ্যামাচরণ ছিলেন গৃহী। গৃহীর ন্যায় জীবনযাপন করতেন। সুগন্ধী তেল, ফরাসডাঙার ধুতি ব্যবহার করতেন। স্বামী ভাষ্করানন্দ সরস্বতীও বড় যোগী ছিলেন, সিঁটকে চেহারা, শুধু হাড় ক-খানা আছে মনে হয়। যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ীর শিষ্য ছিলেন স্বামী কেবলানন্দজী। তিনি ভাষ্করানন্দজীর কাছে বেদ পাঠ শিখতেন। শ্যামাচরণ নিগূঢ় সাধনের অধিকারী, তাই ভাস্করানন্দজীর আগ্রহ তিনি শ্যামাচরণ লাহিড়ীর কাছে তদ্বিষয়ে কিছু শিক্ষা করবেন। একথা ভাস্করানন্দজী স্বামী কেবলানন্দের নিকট জ্ঞাপন করলেন এবং আশ্রমে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। শ্যামাচরণ কেবলানন্দের কাছে এই সংবাদ শুনে রসিকতা করে উত্তর দিয়েছিলেন—’কূপ কি কখনো তৃষ্ণার্তের কাছে ছুটে যায়? তৃষ্ণার্তই তো কূপের কাছে আসে।’ পরবর্তীকালে দুই যোগীর সাক্ষাৎ হয় এবং শ্যামাচরণ ভাস্করানন্দকে যোগসাধনের কয়েকটি নিগূঢ় বিষয় অবহিত করান।
ত্রৈলঙ্গ স্বামীও বিরাট সাধক ছিলেন। সর্বদা উলঙ্গ থাকতেন। কাশীধামে তিনি ভক্তদের কাছে সচল বিশ্বনাথ জ্ঞানে পূজিত হতেন। ত্রৈলঙ্গ স্বামী, শ্যামাচরণ লাহিড়ী, ভাষ্করানন্দজী এই তিন যোগীর সময়ই দেশে ইংরেজের শাসন। প্রচণ্ড প্রতাপ শাসকগোষ্ঠীর । স্যার উইলিয়াম লকহার্ট তখন ভারতের কম্যান্ডার ইন চীফ। স্বামী ভাস্করানন্দ তখন কাশীর আনন্দবাগে অবস্থান করছেন। লকহার্ট সাহেব মাঝে মাঝে স্বামীজীকে দর্শন করতে আনন্দবাগে যেতেন, একদিন দর্শনে গিয়ে নিজের বীরত্ব জাহির করতে লাগলেন—কিভাবে আফ্রীদিদের পরাস্ত করেছেন। অহমিকা প্রকাশ হচ্ছে তার কথায় বার্তায়। কাছে একটি পেনসিল পড়ে আছে। স্বামীজী ঐ পেনসিলটি তুলে আনার জন্য লকহার্ট সাহেবকে বললেন। বারংবার চেষ্টা করেও সাহেব পেনসিলটা তুলতে ব্যর্থ হলেন। ভাস্করানন্দ বললেন—শোন সাহেব, তোমার শক্তি আমি অপহরণ করেছি, তাই তুলতে পারলে না। ক্ষমতার গর্ব ক’রো না, ঈশ্বরই তোমায় শক্তিদান করেছেন। ঈশ্বর তোমায় বুদ্ধি দিয়েছেন, ক্ষমতা দিয়েছেন, তাই আফ্রীদিগণকে তুমি পরাস্ত করতে পেরেছ। ঈশ্বরের দয়ার উপরই সর্বদা নির্ভর করবে।
ত্ৰৈলঙ্গস্বামী হিমালয় থেকে একবার সমতলে নেমে আসছেন। পথে এক গ্রামে দেখলেন ভিড় জমে উঠেছে—এক অনাথা তার একমাত্র শিশুপুত্রের মৃতদেহকে কোলে করে উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দনরতা।শোকে কাতর হয়ে উঠেছে। সান্ত্বনা দেবার ভাষা কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। গ্রামবাসীরা সৎকারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ত্রৈলঙ্গস্বামী সেখানে হাজির হলেন। স্বামীজীর দর্শনে ঐ অনাথা আশ্বস্ত হল। এই বিরাট বিপদেও সে যেন কুল পেল। ঐ মৃত শিশুকে স্বামীজীর পদতলে দিয়ে প্রাণভিক্ষা করল। সহায়হারা মহিলার কান্নায় স্বামীজীর চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। স্বামীজী মৃত শিশুপুত্রের গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। ধীরে ধীরে স্বাস শুরু হল, শিশুর দেহে প্রাণ সঞ্চারিত হল। অনাথার মুখে হাসি ফুটল। এরপরই সন্যাসী গিরিপথে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
তাই কৃপালাভ করতে গেলে দীন ও নিরহঙ্কার হতে হবে। ভালবাসার হৃদয় নিয়ে যেতে হবে। যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী তো বাবু লোক। সহীর্ণ সংস্কার নিয়ে গেলে বোঝাই যাবে না তাঁর সম্পর্কে। নিরহংকার হতে গেলে উদার হতে হয়। তাহলে তাঁর কৃপা লাভ হতে পারে।
[ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-৪/৪/৭৮ ইং ]
[প্রসঙ্গঃসত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ৫৫-৫৭]