স্বার্থপরতা স্বাধীনতা ….. অন্তরায়।- ব্যাখ্যা

সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:

স্বার্থপরতা স্বাধীনতা নয়কো, বরং স্বাধীনতার অন্তরায়।

পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যাঃ

গুরুদেবন—স্বার্থপরতা অর্থাৎ আমি নিজের ভাল দেখলাম—নিজে খাব, নিজে পরব—একে স্বাধীনতা বলে না, বরং স্বাধীনতার অন্তরায়।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—ওটা স্বাধীনতার অন্তরায় হ’ল কেমন ক’রে? স্বাধীনতা মানে কী?

গুরুদেবন—স্বাধীনতা মানে অন্যের অধীনে না থাকা।

—তার মানে নিজের অধীনে থাকা?

—হ্যাঁ।

—তাহলে নিজের ইচ্ছামত থাকা-খাওয়া স্বাধীনতা হ’ল না কেন? নিজের অধীনে থাকতে পারলাম না কেন?

গুরুদেবনকে নিরুত্তর দেখে তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন—স্বার্থপরতা মানে কী? স্বার্থপরতা মানে তো নিজের সুখ-সুবিধা দেখা। আর, স্বাধীনতা মানে? মানে নিজের অধীনে থাকা। দুটোতেই ‘নিজ’ আছে। তাহলে কী হ’ল? ঠিক আছে?

গুরুদেবন কিছু বলছে না দেখে তিনি প্রীতোষকে একই প্রশ্ন করলেন।

প্রীতোষ—যদি আমি নিজের সুখ-সুবিধা দেখি তাহলে স্বাধীন হতে পারছি না।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ। বাণীতে তাই আছে। কিন্তু তা কেমন ক’রে হয়? স্বাধীন মানে কী? স্বাধীন মানে স্ব-এর অধীন। সেই স্ব কে?

প্রীতোষ নিরুত্তর থাকায় শ্রীশ্রীপিতৃদেব দেবলাকে বলতে আদেশ করলেন।

দেবলা—স্বার্থপরতা মানে নিজের ভাল দেখা।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সে তো ঠিকই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, স্বার্থপরতা স্বাধীনতা নয় কেন?

প্রীতোষ—স্বাধীনতা মানে আমি নিজের মত থাকব।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—স্বাধীন মানে স্ব-এর অধীন। স্ব মানে নিজ। নিজটা কে? নিজ মানে কি হাত-মুখ-চোখ-কান ? যখন মানুষ মরে যায় তখন তো হাত-মুখ-চোখ-কান কাজই করে না। তাহলে নিজটা কে?

উপস্থিতদের মধ্যে কেউ কিছু উত্তর দিচ্ছে না দেখে তিনি বললেন—আমি যে পরমপিতার সন্তান সেই যে বুঝ তাই স্ব। আমি পরমপিতার সন্তান, পরমপিতা আমার মধ্যে আছেন—এই বুঝ। পরমপিতা মানে পিতাদের মধ্যে পরম যিনি, শ্রেষ্ঠ যিনি। আর, স্বার্থপরতা মানে নিজ বৃত্তি-প্রবৃত্তির অধীনতা। তাহলে কী হ’ল? আমি পরমপিতার সন্তান, আমি ইষ্টের দাস, তাঁর সেবক—এই যে বোধ, সেইমত চলা—তা-ই স্বাধীনতা। সেই প্রকৃত স্বাধীন যে নিজেকে পরমপিতার সন্তান মনে করে এবং সেই বোধ নিয়ে চলে। আমরা প্রত্যেকেই তাঁর সন্তান—এই বোধই প্রকৃত বোধ। এই বোধ নিয়ে যে চলে সে-ই স্বাধীন। আর,
তখন সে শুধু নিজের স্বার্থ দেখে না। সে সবারই স্বার্থ দেখে, সবার মঙ্গল দেখে, কল্যাণ দেখে।

কেবল আত্ম-স্বার্থকেই যখন আমরা প্রাধান্য দিই, তখন আমরা প্রকৃত স্বাধীন হতে পারি না। অপরের কল্যাণ করাও হয় না। আর অন্যেরাও তা ধরে ফেলে; বলে, লোকটা খুব স্বার্থপর, নিজের ছাড়া কিছু বোঝে না। এতে নিজেই সংকুচিত হয়ে পড়ি, আর তার ফলও ভোগ করতে হয় নিজেকে। নিজের লাভ দেখতে গিয়ে নিজেকেই প্রকৃতপক্ষে ঠকাই।

[ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তারিখ-৩/৬/৭৭ ইং ]

কৃতিদেবতা চৌধুরী বাণীটি আলোচনা করার নির্দেশ পেয়ে বলছে—স্বার্থপরতা মানে নিজের স্বার্থ দেখা। সেটা স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতা আসে সু-এর অধীন হলে।

শ্ৰীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, নিজের অধীনে তো সবাই থাকতে চায়—বৃত্তি-প্রবৃত্তির অধীনে। ইষ্টের সাথে যুক্ত থাকতে হয়, তাতে প্রবৃত্তির অধীন হয় না। যে প্রবৃত্তির অধীন হয় সে স্বাধীনতার স্বাদ বোঝে না। অন্তরায় মানে বাধা।

[পিতৃদেবের চরণপ্রান্তে/তাং-২০/৯/৭৯ ইং]

[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ১৫২-১৫৩]