খবরদার! কাউকে হুকুম… না।-ব্যাখ্যা

সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:

খবরদার! কাউকে হুকুম ক’রে কিংবা চাকর-বাকর দিয়ে গুরুর সেবা-শুশ্রূষা করাতে যেও না—প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হ’য়ো না।

পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :

নির্দেশক্রমে বোধিব্যাস ভট্টাচার্য বাণীটি পাঠ ক’রে আলোচনা শুরু করল।

বোধিব্যাস—আমি হয়তো গুরুর জন্য এক বালতি জল আনতে গেলাম। মাঝপথে অন্য কাউকে দেখতে পেয়ে আমি তার হাতে ঐ বালতি দিলাম। পরে গুরুর কাছে বালতি ধ’রে ঐ জল দিলাম। এতে গুরুর প্রসাদ পেলাম না।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—এতে আরেক প্যাঁচে প’ড়ে গেলাম। এ তো কপটতা ক’রা হ’ল। আমি যা করিনি তা’ করার ভান করলাম। (একটু থেমে) ধর, তোমার বাড়ীতে গুরু গেলেন। তখন তুমি কী করবে?

বোধিব্যাস—তখন জিনিস আনতে আমি অন্যকে দোকানে পাঠাব।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—সে তো প্রয়োজন হ’লে করতে হবেই। নিজে সব কাজ করা যায় না-কি?

—জল দিলাম, আসন দিলাম, খাবার তৈরী ক’রে দিলাম কিংবা বাজার থেকে নিয়ে এলাম।

—হ্যাঁ, এসব তো করবে। কিন্তু তা’ না ক’রে যদি অন্যকে বলি, এই জল দে, জল এনে দে, আসন দে—আসন দে, বাতাস কর্‌—বাতাস কর্‌ ইত্যাদি, অথচ নিজে কিছুই করছি না, তাহলে নিজহাতে গুরুসেবা করা হ’ল না। ঠাকুর এভাবে গুরুসেবার কথা বলছেন না। এভাবে গুরুসেবা করলে কী হয়?—শান্তদীপাকে তিনি প্রশ্ন করলেন।

শান্তদীপা রায়চৌধুরী—আজ্ঞে, তাহলে ওরা সবাই তাঁর প্রসাদ খেয়ে নেবে।

ছোট্ট মেয়ে শান্তদীপার কথা শুনে উপস্থিত সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। শ্রীশ্রীপিতৃদেবও হাসলেন। এবার তিনি প্রশ্ন করলেন নীরদাসুন্দরীকে—বল, কিজন্য গুরু করি আমরা? দীক্ষা নিই কিজন্য? আমরা দীক্ষা নিয়ে গুরু গ্রহণ করি—কেন গুরু গ্রহণ করি?

নীরদাসুন্দরী সরকার—দীক্ষা নিয়ে চললে আমাদের কল্যাণ হবে, মঙ্গল হবে।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, দীক্ষা নিই আমরা আমাদের কল্যাণের জন্য, মঙ্গলের জন্য। হৃষীকেশ কী বল?

হৃষীকেশ দে—আজ্ঞে, আমাদের কল্যাণের জন্যই দীক্ষা নিই।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, গুরুকে খুশি করার জন্যই আমরা গুরুসেবা করি। ধর, তোমার কাছ থেকে একটা জিনিস চাই। তোমার সঙ্গে যদি রাগারাগি করি, তোমাকে খুশি না করি, তাহলে কি তুমি আমাকে ঐ জিনিস দেবে? কিন্তু যদি তোমাকে খুশি করতে পারি তাহলে ঠিকই দেবে। তাই গুরু যদি খুশি হন তাহলে আমার আকাঙ্ক্ষা সিদ্ধ হবেই। যদি আমার ছেলে না হয়, তার জন্য বাসনা করি তখন গুরুকে খুশি করলে ছেলে হবে—বিষয়-সম্পত্তিও হবে। যদি ঈশ্বরলাভের বাসনা থাকে, ঈশ্বরলাভ হবে। একে বলে গুরুর প্রসাদ লাভ করা।

এবার তিনি প্রশ্ন করলেন—প্রসাদ মানে কী?

—জনৈক ভাই—প্রসাদ মানে অনুগ্রহ।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—হ্যাঁ, অনুগ্রহ। প্রসাদ মানে উচ্ছিষ্ট হয়, আবার অনুগ্রহও হয়। দীক্ষা নিয়ে সাধারণতঃ মানুষ কোন-না-কোন কামনা ক’রে থাকে। কেউ ভাবে ছেলে ভাল চাকুরী পাক, মেয়ের ভাল ঘরে বিবাহ হোক, কিংবা নিজের অবস্থার উন্নতি হোক,—এরকম বাসনা থাকেই। গুরুকে সেবা দেওয়ার ফলে এসব বাসনা সিদ্ধ হয়। এর নাম অনুগ্রহ। নিজহাতে গুরুসেবা করলে গুরুর অনুগ্রহ পাওয়া যায়। আর অন্যদের দিয়ে গুরুসেবা করলে অন্যেরা অনুগ্রহ পাবে।—বুঝলে তো?

[ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-১৮/৩/৭৬ ইং]

ধীরা মন্ডল আলোচনার নির্দেশ পেয়ে বাণীটি পুনরায় পাঠ করে বলল—গুরুজন বা ঋত্বিক আমাদের বাড়ি গেল। কাউকে বললাম—জল দাও, কাউকে বললাম—বসার আসন দাও।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—বাণীতে গুরুজন আছে নাকি? গুরু গুরুজন বটে কিন্তু তিনি গুরুজনেরও গুরু। (একটু পর) কাউকে এটা-ওটা করার জন্য বলবি নে?

—না।

শ্রীশ্রীপিতৃদেব—তাহলে কি হবে?

—ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হব।

[পিতৃদেবের চরণপ্রান্তে/তাং-১৯/৮/৭৯ ইং]

[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ১৪০-১৪১]