প্রকৃত হওয়া, সত্যকে জানা, সত্য প্রচার প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর শ্রীহস্তলিখিত সত্যানুসরণ গ্রন্থের পৃষ্ঠা নং ৫৬ – ৬০ এ বিস্তারিত বলেছেন…..
তুমি যেমনতর প্রকৃত হবে, প্রকৃতি তোমায় তেমনতর উপাধি নিশ্চয় দেবেন এবং নিজের ভিতরে তেমন অধিকারও দেবেন ; ইহা নিত্য প্রত্যক্ষ ক’রছ ; তবে আর চাইবে কী? প্রাণপণে প্রকৃত হ’তে চেষ্টা কর। প’ড়ে না পাশ ক’রলে কি ইউনিভার্সিটি কাউকে উপাধি দিয়ে থাকে?
[উপরের “তুমি…থাকে?” বাণীটির ব্যাখ্যা]
ভুলেও নিজেকে প্রচার ক’রতে যেও না বা নিজেকে প্রচার ক’রতে কাউকে অনুরোধ ক’রোঁ না—তা’ হ’লে সবাই তোমাকে ঘৃণা ক’রবে আর তোমা হ’তে দূরে স’রে যাবে।
[উপরের “ভুলেও…যাবে” বাণীটির ব্যাখ্যা]
তুমি যদি কোনও সত্য জেনে থাক আর তা’ যদি মঙ্গলপ্রদ ব’লে জান, প্রাণপণে তারই বিষয় বল এবং সব্বাইকে জানতে অনুরোধ কর ; বুঝতে পারলে সব্বাই তোমার কথা শুনবে এবং তোমার অনুসরণ ক’রবে।
[উপরের “তুমি…ক’রবে।” বাণীটির ব্যাখ্যা]
তুমি যদি সত্য দেখে থাক, বুঝে থাক, তবে তোমার কায়মনোবাক্যে তা’ ফুটে বেরুবেই বেরুবে। তুমি তাতে হারিয়ে না যাওয়া পর্য্যন্ত কিছুতেই স্থির থাকতে পারবে না; সূর্য্যকে কি অন্ধকারে ঢেকে রাখতে পারে?
[উপরের “তুমি…পারে?” বাণীটির ব্যাখ্যা]
তোমার ভিতরে যদি সত্য না থাকে, তবে হাজার বল, হাজার ভান কর, হাজার কায়দাই দেখাও, তোমার চরিত্রে, তোমার মনে, তোমার বাক্যে তার জ্যোতি কিছুতেই ফুটবে না ; সূৰ্য্য যদি না থাকে, তবে বহু আলোও অন্ধকারকে একদম তাড়িয়ে দিতে পারে না।
[উপরের “তোমার…না” বাণীটির ব্যাখ্যা]
যে সত্য প্রচার ক’রতে গিয়ে আপন মহত্ত্বের গল্প করে এবং সবসময় আপনাকে নিয়েই ব্যস্ত, আর নানারকমের কায়দা ক’রে নিজেকে সুন্দর দেখাতে চায়, যার প্রতি-অঙ্গ-সঞ্চালনে ঝলকে-ঝলকে অহঙ্কার ফুটে বেরুচ্ছে, যার প্রেমে অহঙ্কার, কথায় অহঙ্কার, দীনতায় অহঙ্কার, বিশ্বাসে, জ্ঞানে, ভক্তিতে, নির্ভরতায় অহঙ্কার,—সে হাজার পণ্ডিত হোক, আর সে যতই জ্ঞান-ভক্তির কথা বলুক না কেন, নিশ্চয় জেনো সে ভণ্ড; তার কাছ থেকে বহুদূরে স’রে যাও, শুনো না তার কথা; কিছুতেই তার হৃদয়ে সত্য নেই; মনে সত্য না থাকলে ভাব কি ক’রে আসবে।
[উপরের “যে…আসবে” বাণীটির ব্যাখ্যা]
প্রচারের অহঙ্কার প্রকৃত-প্রচারের অন্তরায়। সে-ই প্রকৃত প্রচারক—যে আপন মহত্ত্বের কথা ভুলেও মুখে আনে না, আর, শরীর দ্বারা সত্যের আচরণ করে, মনে সত্য-চিন্তায় মুগ্ধ থাকে এবং মুখে মনের ভাবানুযায়ী সত্যের বিষয় বলে।
[উপরের “প্রচারের…বলে।” বাণীটির ব্যাখ্যা]
যেখানে দেখবে, কেউ বিশ্বাসের গর্ব্বের সহিত সত্যের বিষয় ব’লছে, দয়ার কথা ব’লতে-ব’লতে আনন্দে এবং দীনতায় অধীর হ’য়ে প’ড়ছে, প্রেমের সহিত আবেগভরে সব্বাইকে ডাকছে, আলিঙ্গন ক’রছে, আর যে-মুহূর্ত্তে তার মহত্ত্বের কথা কেউ ব’লছে, তা’ স্বীকার ক’রছে না, বরং দীন এবং ম্লান হ’য়ে বুকভাঙ্গা মত হ’য়ে প’ড়ছে—খুবই ঠিক, তার কাছে উজ্জ্বল সত্য আছেই আছে; আর, তার সাধারণ চরিত্রেও দেখতে পাবে, সত্য ফুটে বেরুচ্ছে।
[উপরের “যেখানে…বেরুচ্ছে” বাণীটির ব্যাখ্যা]
তুমি ভক্তিরূপ তেলে জ্ঞানরূপ প’লতে ভিজিয়ে সত্যরূপ আলো জ্বালাও, দেখবে কত ফড়িং, কত পোকা, কত জানোয়ার, কত মানুষ তোমাকে কেমন ক’রে ঘিরে ধ’রেছে।
[উপরের “ভক্তি… ধ’রেছে” বাণীটির ব্যাখ্যা]
যে সৎকেই চিন্তা করে, সৎকেই যাজন করে, যে সত্যেরই ভক্ত, সেই প্রকৃত প্রচারক।
আদর্শে গভীর বিশ্বাস না থাকলে নিষ্ঠাও আসে না, ভক্তিও আসে না ; আর, ভক্তি না হ’লে অনুভূতিই বা কী হবে, জ্ঞানই বা কী হবে ; আর, সে প্রচারই বা ক’রবে কী?
[উপরের “আদর্শে…কী” বাণীটির ব্যাখ্যা]
প্রকৃত সত্য-প্রচারকের অহঙ্কার তার আদর্শে ; আর, ভণ্ড-প্রচারকের অহঙ্কার আত্মপ্রচারে।
যা’ মঙ্গল ব’লে জানবে, যা’ সত্য ব’লে জানবে, মানুষকে বলবার জন্যে বুক ফাটো-ফাটো হ’য়ে উঠবে, মানুষ তোমাকে যা-ই বলুক না কেন, মনে কিছুই হবে না, কিন্তু মানুষকে সত্যমুখী দেখলে আনন্দ হবে—তবেই তাকে প্রচার বলি।
ঠিক-ঠিক বিশ্বাস, নির্ভরতা ও ভক্তি না থাকলে সে কখনই প্রচারক হ’তে পারে না।
যে নিজেকে প্রচার করে সে আত্মপ্রবঞ্চনা করে; আর, যে সত্যে বা আদর্শে মুগ্ধ হ’য়ে তার বিষয়ে ব’লে, সেই কিন্তু ঠিক-ঠিক আত্মপ্রচার করে।
প্রকৃত সত্য-প্রচারকই জগতের প্রকৃত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। তার দয়ায় কত জীবের যে আত্মোন্নয়ন হয় তার ইয়ত্তা নেই।
তুমি সত্যে বা আদর্শে মুগ্ধ থাক, হৃদয়ে ভাব আপনিই উথলে উঠবে, আর সেই ভাবে অনুপ্রাণিত হ’য়ে কত লোকের যে উন্নতি হবে, তার কিনারা নেই।
[উপরের “তুমি…নেই” বাণীটির ব্যাখ্যা]
গুরু হ’তে চেও না। গুরুমুখ হ’তে চেষ্টা কর ; আর, গুরুমুখই জীবের প্রকৃত উদ্ধারকর্ত্তা।