ইষ্টভৃতি নিয়ে আলোচনা-প্রসঙ্গে ১ম খন্ড

ইষ্টভৃতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গের ১ম খন্ডের ৩৮, ৪৬, ৬১, ৭৮, ১০৯, ১১২, ১৭০ পৃষ্ঠায় আলোচনা রয়েছে। নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলো।

৩০শে কার্তিক, ১৩৪৬, বৃহস্পতিবার (ইং ১৬/১১/১৯৩৯)

সত্যদা (দে) বলছিলেন—কলকাতার এক ভদ্রলোক শ্রীশ্রীঠাকুরের নল কেনা উপলক্ষ্যে অনেককে ফাঁকি দিয়ে তাদের ইষ্টভৃতির টাকা নিয়ে নিয়েছে।

শ্রীশ্রীঠাকুর—অমন দেয় কেন? যারা দেয়, তাদেরই তো দোষ। বিশ্বাস রাখা ভাল, কিন্তু বেকুব হওয়া ঠিক নয়। আর, ইষ্টভৃতির টাকা যে কোথায় পাঠাতে হবে—আমি তা স্পষ্ট ক’রে লিখে দিয়েছি, অপরের উল্টো কথা মেনে নেয় কেন? এ কথা মনে রেখো যে, ইষ্টার্ঘ্য বরাবর আমার অর্থাৎ সৎসঙ্গের ফিলানথ্রপি অফিসেই পাঠাতে হবে। এ কথা সবার জানা উচিত যে, আলো জ্বললে সেখানে যেমন পোকা আসে, তেমনি টিকটিকিও আসে।

১১ই আষাঢ়, ১৩৪৭, মঙ্গলবার (ইং ২৫/৩/১৯৪০)

সকালবেলায় শ্রীশ্রীঠাকুর ছোট ঘরে ব’সে বলছিলেন— ইষ্টভৃতি জিনিসটা আগে ছিল, স্বস্ত্যয়নী জিনিসটা আমি গুছিয়ে দিয়েছি—স্বস্ত্যয়নীর form (স্বরূপ)-টা দিয়েছি, এটা সেদিক থেকে নতুন, আগে থাকলেও বোঝা যেত না। ইষ্টভৃতি, স্বস্ত্যয়নী যদি করে তবে দেখিস্, দুই-এক পুরুষের মধ্যে কী হ’য়ে যায়। দুই-এক পুরুষ পরে বোঝা যাবে।

ইষ্টভৃতিতে পুরুষকার ও দৈবের যোজন হয়—–এর মানে জানতে চাইলে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—পুরুষকার হ’লো motor part (শিল্পী-অঙ্গ) এবং দৈব হ’লো sensory part (অনুভূতি-অঙ্গ)। ইষ্টের জন্য কতকগুলি করা হ’লে— করার যে accumulated effect (সঞ্চিত ফল) তা’ আমাদের বোধে ধরা দেয়— অর্থাৎ কতকগুলি অজানা জানা হ’য়ে আসে এর ভিতর দিয়ে, তার ফলে সেই জানা-মাফিক পরে কাজ করতে সুবিধা হয়। ইষ্টানুগ বোধ, অভ্যাস ও প্রেরণা তদনুগ কৰ্ম্মেই প্রবৃত্ত করে। এইভাবে চলে।

প্রশ্ন করা হ’লো—যে-কোন কাজ করা হোক না কেন, তারই তো effect (ফল) আছে—শুধু ইষ্টভৃতি কেন?

শ্রীশ্রীঠাকুর—যাদের কোন principle (আদর্শ) নেই—তারা ধরতে পারে না, effect (ফল)-টা কাজে লাগাতে পারে না, তাদের experience (অভিজ্ঞতা) হয় না। কারণ, প্রবৃত্তি তাদের নাকে দড়ি দিয়ে যখন যে-ভাবে চালায়, তারা সেইভাবে চলতে বাধ্য হয়। বিচার-বিশ্লেষণ ক’রে সত্তাপোষণী রকমে চলতে পারে না।

৫ই ভাদ্র, ১৩৪৭, বুধবার (ইং ২১/৮/১৯৪০)

…. রাজসাহী থেকে একটি ভাই এসেছেন। তিনি বেকার অবস্থায় আছেন ব’লে জানালেন।

শ্রীশ্রীঠাকুর—একমাস নিজে উপায় ক’রে ইষ্টভৃতি কর্। তখন পথ ঠিক পাবি। …

২৮শে ফাল্গুন, ১৩৪৭, বুধবার (ইং ১২/৩/১৯৪১)

সকালে শ্রীশ্রীঠাকুর হাতমুখ ধুয়ে নিভৃত-নিবাসে এসে বসেছেন পূৰ্ব্বাস্য হ’য়ে, সম্মুখে দিগন্তের বিস্তার, কোন্ দূর-দূরান্তে আকাশের শেষপ্রান্তে যেন তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ, মুখে তাঁর নিৰ্ম্মল প্রশান্তি, হাব-ভাব-ভঙ্গীতে একটা সহজ বৈরাগ্য, স্বচ্ছন্দ নির্লিপ্ততা—মহাযোগেশ্বর যেন যোগে ব’সে আছেন। একলাটি নিরালা আছেন। সত্যেনদা (সাহিত্যশাস্ত্রী) ও প্রফুল্ল এসে এককোণে চুপচাপ বসলেন। কিছু সময় এমনি কাটলো নীরব নিস্তব্ধ। তারপর শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক চেয়ে খেলেন, তামাক খেতে-খেতে আলাপ সুরু হ’লো। সত্যেনদা ইষ্টভৃতি সম্বন্ধে কথা তুললেন।

শ্রীশ্রীঠাকুর আবেগভরে বলছেন—ইষ্টভৃতি করতে গেলেই যাজন ইত্যাদি সব এসে পড়ে। খেটে-পিটে যাঁকে প্রীতির সঙ্গে ভরণ করি, ভাবা-বলায় তাঁর কথা এসেই যায়, তিনি আপন হ’য়ে ওঠেন, অন্তরে বাসা বাঁধেন। ইষ্টভৃতি শুধু বামুন-পণ্ডিতের দেওয়া ব্যবস্থা নয়—মুসলমান, খ্রীষ্টান ইত্যাদি সকলেরই আছে। জেমস্ও ঐ ধরণের কথা বলছেন, তবে আমাদেরটার মধ্যে তপস্যার ভাবটা বেশী আছে। ‘ভবতী ভিক্ষাং দেহি’ ব’লে উপনয়ন-সংস্কারের থেকে আরম্ভ ক’রে আমরণ দিনের পর দিন চলতেই থাকে। এককে কেন্দ্র ক’রে অন্য যা’-সব করা যায়, সবই integrated (সংহত) হ’য়ে ওঠে, গোড়ায় ১ থাকলে, তারপর যত শূন্যই বসাও ততই বেড়ে যায়।

বেলা গোটা নয়েকের সময় শ্রীশ্রীঠাকুর মাতৃ-মন্দিরের বারান্দায় বসা। বাইরে দোখল প্রামাণিককে দেখে বললেন—কি পরামাণিক?

দোখল ওখানে দাঁড়িয়েই কথা বলতে লাগল।

শ্রীশ্রীঠাকুর (সহাস্যে)—তুমি অম্বা কর ক্যান? কাছে আসো, ব’সো, না হ’লি কি কথা ক’য়ে সুখ হয়।

দোখল হাসতে-হাসতে কাছে এসে বসলো।

শ্রীশ্রীঠাকুর তার সঙ্গে পুরোনো দিনের গল্প-গুজব করতে লাগলেন ।

২রা অগ্রহায়ণ, ১৩৪৮, সোমবার (ইং ১৭/১১/১৯৪১)

শ্রীশ্রীঠাকুর সকালে তাসুতে ব’সে শিক্ষকবৃন্দকে বলছেন—টান থাকলেই দেবার বুদ্ধি হয়, attachment-এর (টানের) ধরণই এই—ইষ্টভৃতি তখন আর ব’লে বোঝাতে হয় না—যে বুদ্ধি, যে interest (স্বার্থ) বাধা দেয়, ইষ্টভৃতি করতে থাকলে তার গোড়ায় ঘা পড়ে, আস্তে-আস্তে ঐ করার পথে তা’ adjusted (নিয়ন্ত্রিত) হয়। একটা বড় magnet-এর (চুম্বকের) সামনেই যদি আর একটা ছোট magnet (চুম্বক) থাকে—এবং দূরে একটা needle (সূচ) থাকে, needle-টা (সূচটা) সহজে বড় magnet-এ (চুম্বকে) গিয়ে লাগতে পারে না। ছোটখাট বৃত্তিও ইষ্টের পথে ঐ রকম বাধা জন্মায়। আর, টান হ’লে দোষদর্শন থাকে না। অনন্যচেতা হয়, সবটার purpose (উদ্দেশ্য) বোঝে, meaning (অর্থ) খুঁজে পায়, strong common sense grow করে (প্রবল বোধশক্তিসম্পন্ন হয়)।

ধূর্জ্জটিদা—আপনার প্রতি সেই attitude (মনোভাব) রাখা চলে, কিন্তু সর্ব্বসাধারণ-সম্বন্ধে সে-কথা তো খাটে না।

শ্রীশ্রীঠাকুর—মানুষ অমন একটা জায়গায় ঠিক থাকলে তখন তাকে কেউ শালা বললেও চটে না, considerate (বিবেচক) হয়, বুঝতে চেষ্টা করে কেন এমন সে বলে। ডাক্তারের সাথে রোগী যদি দুর্ব্যবহার করে, ডাক্তার কি তা’তে রোগী ছাড়ে? ডাক্তার বোঝে, রোগে এ-সব করাচ্ছে। ভাল ব্যবসা যারা করে তারা যে-কোন খরিদ্দারের সঙ্গে কেমন সুন্দর ব্যবহার করে। ওটা তারা স্বভাব ক’রে নেয়। যারা যত selfcentred (আত্মকেন্দ্রিক), তাদের foresight (পরিণামদর্শিতা) তত কম, ignorance (অজ্ঞতা) তত বেশী।

আর-একটা জিনিস, ভাল কথা যখন যা’ শুনবি তখন-তখন সেই অনুযায়ী কাজ করা লাগে, পাঁচজনের মধ্যে চারিয়ে দেওয়া লাগে, নচেৎ জেমস্ যা’ বলেছে chance lost (সুযোগ হারান)। এ না-করলে চরিত্রে বা মাথায় তা’ থাকে না।

৩রা অগ্রহায়ণ, ১৩৪৮, মঙ্গলবার (ইং ১৮/১১/১৯৪১)

প্রফুল্ল—ইষ্টভৃতির pressure-এ (চাপে) কী হয়?

শ্রীশ্রীঠাকুর—সব সময় সব কাজের মধ্যে ঐ ধান্ধা যদি থাকে, ইষ্টভৃতির যোগাড় করতেই হবে, তখন জীবনের সবখানির মধ্যে ইষ্ট ওতপ্রোতভাবে গেঁথে যান।

২০শে অগ্রহায়ণ, ১৩৪৮, শুক্রবার (ইং ৫/১২/১৯৪১)

আজও বাঁধের ধারে তাসুতে প্রাতঃকালীন বৈঠকে অনেক কথাবার্ত্তা হ’লো।

প্রফুল্ল—ইষ্টভৃতি কিছুদিন করলেই তো সহজ হ’য়ে যায়, খুব effort (প্রচেষ্টা) কিছু করতে হয় না, তা’তে কি আমাদের উন্নতি হয় ?

শ্রীশ্রীঠাকুর—Normal (সহজ) হ’লেও একটা superfluity of energy (উদ্বৃত্ত শক্তি) থেকেই যায়, এবং সব কাজেই তার সাহায্য পাওয়া যায়। ইষ্টভরণ- ধান্ধা যার মন-মাথা জুড়ে থাকে, তার প্রবৃত্তিগুলিও ধীরে-ধীরে সুবিন্যস্ত হ’য়েওঠে, তার সব-কিছুর মধ্য দিয়ে একটা একসূত্রনিবদ্ধ সমাহার হ’তে থাকে, তাই বোধও তেমনি ক’রে ফুটে ওঠে। তা’ ছাড়া, সে শুধু ভাব-বিলাসী হয় না, তার ভাবা, করার মধ্যে একটা সঙ্গতি থাকে। এইভাবে জীবনে কৃতকার্য্যতার পথ তার খুলে যায়। নিত্য ইষ্টভোগের নৈবেদ্য নিবেদন ক’রে একটা আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায়। প্রসাদের মধ্যে প্রসারও আছে। দিয়ে পুষ্ট করার মধ্যেই পেয়ে পুষ্ট ও উন্নত হওয়ার পথ আছে। আবার, ইষ্টভৃতি ক্রম-বর্দ্ধমান ক’রে রাখতে হয়, অমনতর প্রচেষ্টা নিয়ে চললে, অমনতর তপস্যারত থাকলে তার উন্নতি অনিবাৰ্য্য। ভোজ্যটা বা পয়সাটা ইষ্টভৃতির মূল কথা নয়, ওর মূল কথা হ’লো ইষ্টকে দেওয়ার আবেগ, তাঁকে না দিয়ে, না খাইয়ে আমার ভাল লাগে না, তাই সর্ব্বাগ্রে আমার তাঁর সেবার আয়োজন। ঐ আবেগ যখন মানুষের অন্তরে নেশার মতো পেয়ে বসে, সে তখন তার সব করার ভিতর-দিয়ে তাঁকেই অর্ঘ্য- নন্দিত করতে চায়, জীবনে যেন তার একটা অফুরন্ত উৎসাহ জেগে যায়।

Loading