ইষ্টভৃতি নিয়ে আলোচনা-প্রসঙ্গে ১৩শ খন্ড

ইষ্টভৃতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গের ১৩শ খন্ডের ৯, ৭৬, ৮৭, ৯১, ১২০, ১৩১, ১৪৭ পৃষ্ঠায় আলোচনা রয়েছে। নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলো।

৩২শে আষাঢ়, ১৩৫৫, শুক্রবার (ইং ১৬/০৭/১৯৪৮)

……
কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—আমরা যদি তেমন একটা বিশ্ববিদ্যালয় গ’ড়ে তুলতে পারি তাহ’লে ইউরোপ, আমেরিকা থেকেও দলে-দলে ছেলে পাঠাবে আমাদের এখানে। ওদের খুব ঝোঁক।

প্রফুল্ল—আশ্রমের প্রায় বাড়ীর ছেলেমেয়েরা নিয়মিত ইষ্টভৃতি করে, এতে তাদের চরিত্র গঠনের অনেকখানি সহায়তা হয়।

শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খেতে-খেতে সোল্লাসে বললেন—ইষ্টভৃতি একটা জবর জিনিস। এতে যে কত কী হ’তে পারে ব’লে শেষ করা যায় না—যদি কিনা জায়গামত পড়ে।

প্রফুল্ল—জায়গামত মানে কী? এর মানে কি বুঝবো যুগ-পুরুষোত্তমকে উদ্দেশ্য ক’রে?

শ্রীশ্রীঠাকুর—হ্যাঁ! ইষ্টভৃতি skill (নিপুণতা) বাড়িয়ে দেয়, normal ardour (স্বাভাবিক উৎসাহ) গজিয়ে তোলে। তাই একে বলে সামর্থী-যোগ। আমি একবার সামর্থী-যোগ সম্বন্ধে স্বপ্ন দেখেছিলাম। জেম্স্ এই জাতীয় অনুশীলনের উপকারিতা-সম্বন্ধে কেমন সুন্দর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ক’রে গেছেন।

উমাশঙ্করদা (চরণ)— স্বস্ত্যয়নী জিনিসটা কী? ইষ্টভৃতি তো আছে।

শ্রীশ্রীঠাকুর—স্বস্ত্যয়নী একটা ব্রতবিশেষ। পাঁচটি নীতি নিয়ে স্বস্ত্যয়নী। এতে ক্রমোন্নতির অন্তরায়গুলি যেমন নিরুদ্ধ হয়, তেমনি উন্নতিলাভের পক্ষে অপরিহার্য্য গুণগুলি আয়ত্ত হয়, যাতে ক’রে সর্ব্ববিধ অমঙ্গল দূরীভূত হ’য়ে মঙ্গলের পথ প্রশস্ত হয়। তাছাড়া, এতে গ্রহবিপাক খণ্ডে। গ্রহ মানে that which makes one’s intellect obsessed (যা’ মানুষের বুদ্ধিকে অভিভূত করে)।যেমন শনিগ্রহ, রাজগ্রহ। কৰ্ম্মফলে গ্রহ কুপিত হ’লে যে সব শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করে, তার থেকে ঢের বেশী ফল হয় স্বস্ত্যয়নীর নীতিগুলি নিখুঁতভাবে পালন করায়। এ ব্রতের মূল কথা হ’লো যুগপৎ এই পাঁচটি নীতি পালন করতে হবেঃ—
(১) শরীরকে ইষ্টপূজার যন্ত্র বিবেচনা ক’রে সুস্থ ও সহনপটু ক’রে তুলতে হবে।
(২) মনের কোণে যখনই যে-কোন প্রবৃত্তি উঁকি মারুক না কেন, তাকে ইষ্টস্বার্থ ও ইষ্টপ্রতিষ্ঠার অনুকূলে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে।
(৩) যে কাজে যখনই যা’ ভাল ব’লে মনে হবে, তা’ কাজে ফুটিয়ে তুলতে হবে।
(৪) পারিপার্শ্বিকের বাঁচা-বাড়াকে নিজেরই বাঁচা বাড়ার স্বার্থজ্ঞানে তাদের যাজনসেবায় ইষ্টে আকৃষ্ট ও যুক্ত ক’রে উন্নত-চলৎশীল ক’রে তুলতে হবে।
(৫) আর, চাই নিজের কৰ্ম্মশক্তি, উদ্ভাবনীবুদ্ধি ও অর্জ্জনপটুতাকে বাড়িয়ে তুলে নিত্য বিধিমাফিক অর্ঘ্য নিবেদন।

এই সবগুলি আচরণ করলে তবেই স্বস্ত্যয়নী পালন করা হলো। সূর্য্যের যেমন রোজই সংক্রমণ হচ্ছে। একটা range (এলাকা) থেকে যখন অন্য range-এ(এলাকায়) যায়, তখন তাকে বলে সংক্রান্তি। স্বস্ত্যয়নী ব্রত নিষ্ঠাসহকারে প্রতিটি নীতিবিধিসহ পালন করতে থাকলে আমাদেরও তেমনি সূর্য্যের সাথে সাথে নিত্য সেই ব্রতানুযায়ী জীবন-চলনার ক্ষেত্রে ধীরে-ধীরে এক নূতন জগতে সংক্রমণ অর্থাৎ অনুপ্রবেশ সংঘটিত হ’তে থাকে। এই ইষ্টাভিমুখী সংক্রমণের ফলে প্রবৃত্তি-অভিভূতির নাগপাশ থেকে আমরা ধীরে-ধীরে মুক্তিলাভ করতে পারি, তখন গ্রহ বা গেরো বা complex-এর (প্রবৃত্তির) knot (গ্রন্থি) আমাদের কাবেজ করতে পারে কমই।

পূর্ব্ব প্রসঙ্গের সূত্র ধ’রে শ্রীশ্রীঠাকুর ব’লে চললেন—ইষ্টভৃতি দীক্ষা নিলেই করতে হয় দীক্ষাকে চেতন রাখবার জন্য, living অর্থাৎ জীয়ন্ত রাখবার জন্য। যজন-যাজন ইষ্টভৃতি অস্তিত্বকে ধ’রে রাখে। আরোতর বর্দ্ধনার জন্য স্বস্ত্যয়নী ব্রত গ্রহণ ও পালন ক’রে চলতে হয়। Ideal (আদর্শ), নিজে ও environment (পরিবেশ)—এই তিনটের co-ordination (সমন্বয়)-এর ভিতর দিয়েই জীবন ক্রমবর্দ্ধমানতার পথে চলে। স্বস্ত্যয়নীর নীতিগুলি এই co-ordination (সমন্বয়)-কে বাস্তবজীবনে আরও আরও প্রতিষ্ঠিত ক’রে তোলে। স্বস্ত্যয়নীর প্রথম চারটি নীতি যতই পালন করি না কেন ইষ্ট-পূজার offerings (অর্ঘ্য) ছাড়া পূজাটা কিন্তু decentric (বিকেন্দ্রিক) হ’য়ে যায়। তাই, স্বস্ত্যয়নী-ব্রতের ঐ অর্ঘ্য-নিবেদন কিন্তু নিতান্তই essential (প্রয়োজন)। ঐটা হলো বোঁটা। আদত কথা হলো, ইষ্টের বাস্তব পোষণ-পূরণ আমাদের জীবনের প্রথম ও প্রধান করণীয়। তাঁর উপর প্রাণের টান না গজালে আমাদের ভিতরের সত্তা প্রকৃত উন্নতির পথ পায় না। তাঁর জন্য করতে-করতে তাঁর উপর টান গজায়। তাই, নিষ্ঠাসহকারে এই পাঁচটি নীতিই পালন করা লাগে। প্রতিমাসে তিন টাকা অর্ঘ্য ইষ্ট-সকাশে নিবেদন ক’রে সারামাসে নিবেদিত অর্ঘ্যের বাদ বাকীটা স্বস্ত্যয়নীর উদ্বৃত্ত হিসাবে রেখে দিতে হয়। সেটা জমতে জমতে একটা বিরাট fund (তহবিল) হ’য়ে যায়। তা’ দিয়ে ইষ্টোত্তর স্থাবর সম্পত্তি করতে হয়। তুমি সেবাইত হিসাবে প্রতি বৎসর সেই সম্পত্তির আয়ের এক পঞ্চমাংশ নিতে পার। আর, তার চার-পঞ্চামাংশের উপর অধিকার ইষ্টের।

উমাশঙ্করদা—প্রত্যেকেই যদি ইষ্টোত্তর সম্পত্তি করে তবে একদিন সমগ্র রাষ্ট্রই তো ইষ্টের হ’য়ে যেতে পারে।

শ্রীশ্রীঠাকুর হেসে বললেন—একেবারে!

উমাশঙ্করদা—সম্পত্তির আয়ের যে চার-পঞ্চমাংশ ইষ্ট পাবেন তার utilisation (ব্যবহার) কিভাবে হবে?

শ্রীশ্রীঠাকুর— Utilisation (ব্যবহার) হবে country ও people (দেশ ও জনগণ) এর জন্য। এমনি হ’লে you can do anything and everything (তোমরা সব-কিছু করতে পার)। That is a common fund for the growth of all (সবার বৃদ্ধির জন্য সেটা হ’ল একটা সাধারণ তহবিল)।
……

১০ই শ্রাবণ, ১৩৫৫, সোমবার (ইং ২৬/০৭/১৯৪৮)

শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতে প্রাঙ্গণে ইজিচেয়ারে ব’সে আছেন। সুশীলদা (বসু), শরৎদা (হালদার) প্রভৃতি কাছে আছেন।

একজন ঋত্বিক্ বললেন—বেকায়দায় প’ড়ে ইষ্টভৃতি, স্বস্ত্যয়নী ভেঙ্গে ফেলেছি। আয় তো এক দক্ষিণা।

শ্রীশ্রীঠাকুর—ওখানে গোল হ’লে বুঝতে হবে, সেটা একটা খারাপ লক্ষণ, তখন জীবনের অন্য সব ব্যাপারেও গোল ঢুকে যাবে। আবার ওটা ঠিক থাকলে অন্য তুচ্ছ গোল আটকাতে পারে কম। সেগুলি বরং শুধরে যেতে থাকে, অবশ্য চেষ্টা চাই। মানুষ আয়ের কথা কয়, কিন্তু আয় যে কে করে তা’ জানে না। আয় করে নিষ্ঠাবান চরিত্র, আর তাকেই ঘায়েল ক’রে সুরাহা করতে চায়।

কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—মানুষকে ভালবাস কিন্তু এমনভাবে নয় যাতে তার মন্দটা প্রশ্রয় পায়। মন্দ মানে তাই যা’ তা’র বাঁচা-বাড়ার পরিপন্থী।
…….

১৩ই শ্রাবণ, ১৩৫৫, বৃহষ্পতিবার (ইং ২৯/০৭/১৯৪৮)

…….
শরৎদা—যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি না ক’রে আপনার কাজ যদি করে, তবে হয় না?

শ্রীশ্রীঠাকুর—তা না হ’লে করবে, যেমন দরদহীন চাকর মনিবের কাজ করে, ঢের করে কিন্তু তার চারিত্রিক বিকাশ কিছু হয় না, চাকর চাকরই থাকে, কিন্তু যে অনুরাগভরে গুরুর কাজ করে, তার সমস্ত কাজগুলি করাগুলি, চিন্তাগুলি, পারাগুলি তাঁকে সার্থক করার জন্য নিয়োজিত করে, তার হওয়া ও পাওয়াটাও তাঁকে নিবেদন করে, যার ফলে তার সবকিছু meaningfully integrated (সার্থকভাবে সংহত) হ’য়ে ওঠে, normally (স্বাভাবিকভাবে) সে প্রাজ্ঞ হ’য়ে ওঠে। একটা কুকুরেরও যদি প্রভুর উপর টান হয়, তাতেও সে নিজস্ব রকমে ধীরে-ধীরে প্রাজ্ঞ হ’য়ে ওঠে। প্রভুর সেবাই হয় তার প্রধান লক্ষ্য। সেবা মানে পরিপোষণ, পরিপূরণ, পরিরক্ষণ। তার ধান্ধাই থাকে ঐ। মাষ্টারের গায় কেউ একটু হাত লাগালে, সে হয়তো অমনি হাউ-হাউ করে ওঠে। তাকিয়ে যখন দেখল যে সে প্রভূর কোন ক্ষতি করার উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি, প্রভুকে ভালবাসে সে, তখন থামলো।

শরৎদা—কুকুর তো নামধ্যান করে না।

শ্রীশ্রীঠাকুর—তার মত ক’রে সে করে। ভাবে, কানটা থাকে সেই দিকে, চোখটা থাকে সেই দিকে, তার ধ্যান লেগেই থাকে। প্রভু আসে যখন, দূর থেকেই সাড়া টের পায়। টের পাওয়া মাত্র তখনই উঠে দাঁড়াল। তার চোখ, কান, মন সবসময় প্রভুর সেবায় সজাগ, উদগ্র, উন্মুখ, নিরলস। যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি হ’লো মানুষের উন্নতির main pivot (প্রধান স্তম্ভ)। এ না হ’লে উন্নতি ফস্কে যাবে। এই তিনটে পায়ার উপর দাঁড়িয়ে আছে জীবন। একটা সরিয়ে নিলে ততখানি খোঁড়া হ’য়ে পড়বে। যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি, করলে কাটে মহাভীতি।

১৫ই শ্রাবণ, ১৩৫৫, শনিবার (ইং ৩১/০৭/১৯৪৮)

শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতে অশ্বত্থ গাছের নীচেয় তাঁবুতে শুভ্রশয্যায় সমাসীন। কাছে আছেন দক্ষিণাদা (সেনগুপ্ত), সুরেনদা (ভৌমিক), প্রবোধদা (মিত্র), পণ্ডিত ভাই (ভট্টাচার্য) প্রভৃতি এবং মায়েরা।

সুরেনদা—ব্যবসায়, চাকরী, যাজন-কাজ—কোন্‌টা আমার পক্ষে ভাল?

শ্রীশ্রীঠাকুর—যে-দিকে তোমার ঝোঁক তাই করাই ভাল। তাতে অর্জ্জনের পথও খুলে যায়। যাই কর, তার সঙ্গে যজন, যাজন, ইষ্টভৃতিকে মুখ্য ক’রে চলা লাগে। That is the way to achieve best (তাই হ’লো সৰ্ব্বোত্তমকে অধিগত করার পন্থা)।

১৯ই শ্রাবণ, ১৩৫৫, বুধবার (ইং ০৪/০৮/১৯৪৮)


শ্রীশ্রীঠাকুর পর-পর কয়েকটি বাণী দিলেন।

বাণীগুলি প’ড়ে শোনান হলো।

তারপর মতিদা বললেন—আমি বীরভূমে এসে অবস্থায় চাপে ইষ্টভৃতি করতে পারছি না, ইষ্টভৃতির পয়সা ভেঙ্গেও ফেলেছি।

শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখে-মুখে উদ্বেগের চিহ্ন ফুটে উঠলো, তিনি চকিত কণ্ঠে বললেন—ইষ্টভৃতি বিধিমত করবিই, ওতে গোলমাল করলে অস্তিত্ব টালমাটাল ক’রে ফেলাবে। ইষ্টভৃতি ছেড়ে কী নিয়ে জীবনে দাঁড়াবি? কী নিয়ে যুঝবি? বিপদ-বারণ বাস্তব ঢাল আমাদের হাতে ঐ একটাই দিয়েছেন পরমপিতা। আর যা’–যা’ নিত্য অবশ্য-করণীয় আছে, কোনটাই উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু ইষ্টভৃতির বিধান পরমপিতার এক বিশেষ দয়ার দান। যা’ বললি অমন কাম আর করিস্ না। ইষ্টভৃতি ভেঙ্গে থাকলে দুঃখ পাবেই। বিহিত প্রায়শ্চিত্ত ক’রে এখনই ঠিকমত তোমার সাধ্য-অনুযায়ী করতে সুরু করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। ওর উপর নির্ভর ক’রে দুরবস্থার ভিতর দাঁড়িয়ে আছি আমরা। কতবার কতক্ষেত্রে দেখা গেছে এর অমোঘ ফল। ইষ্টভৃতিই আমাদের বাঁচিয়ে চালিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।

২১শে শ্রাবণ, ১৩৫৫, শুক্রবার (ইং ০৬/০৮/১৯৪৮)

…..
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর নিম্নলিখিত বাণীটি দিলেন—

সংশোধনই যদি চাও,
নিজের ভুলকে নিজেই আবিষ্কার কর,
আর কাজের ভিতর দিয়ে
তাকে তখনই পরিশুদ্ধ কর;
—বালাই হ'তে বাঁচবে অবিলম্বে।

কেষ্টদা—Confession-এও (স্বীকারোক্তিতেও) তো উপকার হয়!

শ্রীশ্রীঠাকুর—উপযুক্ত শ্রেয়ের কাছে confession (স্বীকারোক্তি) করতে গিয়ে এইটুকু ফল পাওয়া যায় যে, তাঁর কথায় ভুলত্রুটি ও দোষের কারণ ও নিরাকরণের সূত্রটা নিজের কাছে আরো ভাল ক’রে ধরা পড়ে। তাই খ্যাপনের কথা আছে। তবে আত্মবিচার ও আত্মবিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে সূত্রটা যদি নিজে ধরা যায়, তা’হলে সব চেয়ে ভাল হয়। শুধু ধরলে হবে না, লেগে বেঁধে নিজেকে সংশোধন করতে হবে। এতে ভাল হওয়ায় পথ ত্বরান্বিত হয়। এটা সাধনার একটা অপরিহার্য অঙ্গ। নইলে নিজের গলদের গায় হাত দিচ্ছি না, অথচ নামকাওয়াস্তে জপধ্যান করে যাচ্ছি, তাতে চিত্তশুদ্ধি হয় কমই। তবু তা’ মন্দের ভাল। নিয়মিত নামধ্যান করতে থাকলে ইষ্টের প্রতিকূল প্রবৃত্তি যেগুলি আছে, প্রথমটা সেগুলি মনের মধ্যে জটলা পাকাতে থাকে ও মনকে ইষ্টে তন্ময় হ’তে দেয় না। সেগুলি তখন ধরা পড়ে ও একটা অস্বস্তি-বোধও জাগে। আবার অভ্যাসের ফলে নামধ্যানের রস ও আনন্দ যে ছিটে-ফোঁটাও পায়, সেজন্য তার লোভ বেড়েই চলে। তখন ঐ আকর্ষণে সে অন্তরায়গুলিকে উপেক্ষা করেই হো’ক, অতিক্রম করেই হোক বা নিয়ন্ত্রণ করেই হোক পরমপিতার দিকে এগিয়ে না চ’লে পারে না। তাই যার ভিতর যত আবোল-তাবোলই থাক না কেন সে যদি নাছোড়বান্দা হ’য়ে যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি, নিয়ে লেগে-প’ড়ে থাকে, সময়ে তার পরিবর্ত্তন হ’তে বাধ্য।

নিৰ্ম্মলদা (দাশগুপ্ত)—একজন বহুদিন ধরে যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি করছে, অথচ তার চরিত্রের কোন পরিবর্ত্তন হ’চ্ছে না—এমনতর তো ঢের দেখা যায় !

শ্রীশ্রীঠাকুর—হয়তো তার করার খাঁকতি আছে। আবার হয়তো তার বদভ্যাসগুলি এত প্রবল, যে সে চেষ্টা সত্ত্বেও সেগুলির সঙ্গে পেরে ওঠে না। তাছাড়া বাইরে কোন পরিবর্ত্তন ধরা না পড়লেও, দোষ করলেই তার ভিতরে হয়তো এমন একটা যন্ত্রণা হয়, যা’ আগে তার হ’তো না। তার মানে সে সচেতন হ’চ্ছে, এইটেই একটা শুভলক্ষণ। এতে বোঝা যায় যে, সে সংশোধনের পথে পা দিয়েছে। কত জন্মের সংস্কার থাকে, হঠাৎ কি যায়? তবে ইষ্টের প্রতি বুকফাটা টান হ’লে কোন্ ফাঁকে যে কি ঘটে যায় টের পাওয়া যায় না। আবার যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি করতে-করতে মানুষের জন্মগত গুণগুলি খুব পুষ্ট হ’তে থাকে, ঐগুলি যত বিস্তার লাভ করে তার পরোক্ষ ফলস্বরূপ অবগুণগুলির কিন্তু তত নিরসন হতে থাকে। শেষ কথা, মানুষ তার দোষ-গুণ সবই যদি আত্মকেন্দ্রিকতার বালাই না-রেখে বিধিমত ইষ্টের সেবায় বা ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠায় লাগাতে পারে, তা’হলেই তো মার দিয়া কেল্লা! ওকেই তো কয় গুণাতীত অবস্থা বা মুক্তি। এটা সাচ্চা ভক্তির সহচর। তাই বাইরে থেকে মানুষকে কী-ই বা বুঝবা, কী-ই বা বিচার করবা? প্রবৃত্তির তাগিদে সে যেমন ভুল করে, বাঁচার তাগিদে সে আবার তেমনি ভুল এড়াতেও চেষ্টা করে। তাই কারও সম্বন্ধে আমার হতাশ হ’তে ইচ্ছা করে না। কারণ জানি, সব অবস্থার মধ্যে অমৃতের পিপাসা মানুষের অন্তঃশায়ী হ’য়ে থাকেই। আত্মা যে চিরচলৎশীল—অমর। তাই মানুষের বিকারটাকে বড় ক’রে না ধ’রে তার ভিতরের সদ্ভাবকে ক্রমাগত চেতিয়ে তুলতে হয়—উৎসাহ দিয়ে ও তারিফ ক’রে।
…..

২৩শে শ্রাবণ, ১৩৫৫, রবিবার (ইং ০৮/০৮/১৯৪৮)

….
হুগলি জেলায় বসবাসকারী এক উদ্বাস্তু দাদা হতাশভাবে নিজের দুরবস্থার বর্ণনা দিলেন।

শ্রীশ্রীঠাকুর অভয় দিয়ে বললেন—খেটে খাওয়ার বুদ্ধি থাকলে ভাতের অভাব হবে না। মাথা ও গা-গতর খাটিয়ে চলতে যদি অভ্যস্ত হও, দেখবে নিজের সংসার তো চালিয়ে নিতে পারবেই, সেই সঙ্গে অন্যের দায়-দায়িত্বও বহন করতে পারবে। তবে যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি যেন ঠিক থাকে। এইগুলি হ’লো বাঁচার বুনিয়াদ।
…….

Loading