ইষ্টভৃতি নিয়ে আলোচনা-প্রসঙ্গে ১২শ খন্ড

ইষ্টভৃতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গের ১২শ খন্ডের ১১১, ১১৫ পৃষ্ঠায় আলোচনা রয়েছে। নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলো।

১৪ই আষাঢ়, ১৩৫৫, সোমবার (ইং ২৮/৬/১৯৪৮)

শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতে বড়াল-বাংলোর বারান্দায় তক্তপোষে শুভ্রশয্যায় সমাসীন। সুশীলদা (বসু), বঙ্কিমদা (রায়), প্যারীদা (নন্দী), গোপেনদা (রায়), হরিপদদা (সাহা), চপলদা (কুণ্ডু), মুরারিদা (দাঁ) প্রভৃতি কাছে আছেন।

বহিরাগত এক দাদা দোকান সুরু করবেন ব’লে পাঁচটি টাকা প্রণামী নিবেদন করলেন।

শ্রীশ্রীঠাকুর সহাস্যে বললেন—সবই তো হলো, আমারটা কবে হবে? রামকানালির জন্য যে টাকা সংগ্রহের কথা বলেছি, তাড়াতাড়ি ক’রে ফেল।

উক্ত দাদা—চেষ্টা করব।

পরক্ষণে তিনি বললেন—অনেক সময় ঠিক ৩০ দিনের দিন ইষ্টভৃতি পাঠাতে পারি না।

শ্রীশ্রীঠাকুর—নিতান্ত অশক্ত না হ’লে ঠিক দিনেই পাঠাতে হয়। এ-ব্যাপারে নিয়মনিষ্ঠ হ’লে এই জিনিসটা চারায়ে যায় জীবনের সর্ব্বত্র। তাতেই efficiency (দক্ষতা) আসে। এটা একটা মৌলিক ধর্মানুষ্ঠানমূলক জিনিস কিনা, এতে গোলামাল হওয়া ঠিক নয়। তাতে সেই গোলমাল জীবনের অন্য ক্ষেত্রেও আক্রমণ করে। এটা সেইজন্য ঠিক নিয়মমত করা লাগেই। ইষ্টভৃতিকে বলে সামর্থ্যিযোগ psychophysical concentration (শরীর মানস একাগ্রতা)। সমগ্র সত্তার মধ্যে এর ক্রিয়া হ’য়ে থাকে। এইটুকু করে ব’লে মানুষ অনেকখানি রেহাই পেয়ে যায়। কারণ, এই করার ফলে তার ভিতর একটা শক্তি সঞ্চিত হয়, যা’ তাকে বিপদকালে রক্ষা করে। জেম্স্ এই ধরণের নিষ্ঠানন্দিত সাধনার সুফল সম্বন্ধে বলেছেন—সাধারণ দুর্ব্বল মানুষ যখন ঝড়ের মুখে তুষের মত উড়ে যায় এবং অনেক কিছুর ভিত্তি যখন টলতে থাকে, তখন ঐ সাধনশীল মানুষ অটল স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ, বাইরের ঝড়-ঝাপ্টা তাকে কাবু করতে পারে কমই। জেম্স্ সদভ্যাসের অনুশীলনকে ইনসিউরেন্সের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ওর মধ্যে দেওয়া-নেওয়ার প্রশ্ন আছে। আমি তা’ বলি না। আমি বলি—কোন প্রত্যাশা রেখো না, ভালবেসে ক’রে যাও। নিজের সুবিধার কথা, স্বার্থের কথা ভেবই না। ইষ্টই তোমার একমাত্র স্বার্থ হউন। তাঁকে বাদ দিয়ে আত্মস্বার্থের দিকে নজর দিয়েছ কি আত্মস্বার্থের মূলে কুঠারাঘাত করেছ এবং ইষ্টস্বার্থও ঘায়েল করেছ। ‘নিরাশীর্নির্ম্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ক বিগতজ্বরঃ’ (ফলাভিসন্ধিরহিত, মমত্বহীন ও শোকশূন্য হ’য়ে তুমি যুদ্ধ কর)–কেষ্টঠাকুর এই কথা বলেছেন। ক’রে যদি Lord (প্রভু)-কে tempt (পরীক্ষা) করতে যাই, তাহলে উল্টো ফল হবে। গীতায় আছে “সংশয়াত্মা বিনশ্যতি” (সন্ধিগ্ধচিত্ত ব্যক্তি বিনষ্ট হয়)। তুমি যদি সন্দেহ কর আমি বাপের ছেলে কিনা, তাহ’লে তোমার কি অবস্থা দাঁড়ায়? তা’ যেমন কর না, এ ব্যাপারেও তেমনি কোন সন্দেহ ক’রো না। সংশয়, সন্দেহ নীচস্থ রাহুর কাজ। হয়তো ইষ্টকাজ করতে-করতে ভাবলে এতে আমার কী লাভ? পেট ভরছে তো আর একজনের।

চপলদা—এটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

শ্রীশ্রীঠাকুর—সর্ব্বদাই তো তা’ করছ। একজনকে হয়তো শালা বলতে ইচ্ছে মনে-মনে, কিন্তু তার effect (ফল) ভেবে action-এ (কাজে) কথার expression (অভিব্যক্তি) দিচ্ছ না, অন্যভাবে কথা বলছ। ওটা ignore (উপেক্ষা) করছ। Action-এ (কাজে) expression (অভিব্যক্তি) দিলে, তার impression (ছাপ) মনে থেকে যায়। শুধু চিন্তা আসলে আর তার expression (অভিব্যক্তি) না দিলে উবে যায়। অবশ্য, অভিভূত হয়ে ক্রমাগত কোন খারাপ চিন্তা করা ভাল নয়, তাতে action-এ (কাজে) expression (অভিব্যক্তি) আসার সম্ভাবনা থাকে। সে অবস্থার অন্য ভাল কাজে ব্যাপৃত হ’য়ে মনের গতি পরিবর্তন ক’রে দিতে হয়। তাই, প্রয়োজনমত adjust (নিয়ন্ত্রণ) করে, ignore (উপেক্ষা) ক’রে বা withdraw (প্রত্যাহার) করে চলতে হয়। ইষ্টানুরাগ মানুষের যত সত্তায় গেঁথে যায়, ততই সে প্রবৃত্তিকে সহজে চিনতে পারে ও অতিক্রম করতে পারে।

চপলদা—পারিপার্শ্বিকের উপরও তো অনেকখানি নির্ভর করে।

শ্রীশ্রীঠাকুর—পারিপার্শ্বিক তোমার নির্ম্মম। যে আঘাত দেবার সে আঘাত দেবেই। তুমিই হ’লে only agent (একমাত্র কৰ্ত্তা) যে adjust, digest ও assimilate (নিয়ন্ত্রণ, হজম ও আত্মীকরণ) করবে। এর ভিতর-দিয়েই জ্ঞান বাড়ে, শক্তি বাড়ে, সহনশীলতা বাড়ে।

সুশীলদা—তার জন্যও তো প্রয়োজন ইষ্টপ্রাণতা।

শ্রীশ্রীঠাকুর— হ্যাঁ! আপনি একটা বাঁশের সঙ্গে শক্ত দড়ি বেঁধে রাখেন, তারপর ঐ দড়িতে ঢিল মারেন, দড়িটা এদিক যাবে, ওদিক যাবে, কিন্তু একেবারে বাঁশ থেকে বিচ্ছিন্ন হ’য়ে উড়ে যাবে না। আবার, ঐ দড়িটা যদি বাঁশের সঙ্গে বাঁধা না থাকে, আলগাভাবে বাঁশের গায় লেগে থাকে, তাহ’লে ঢিলের সঙ্গে-সঙ্গে কোথায় ছিটকে পড়বে। ইষ্টের উপর আমাদের এতখানি টান গজান চাই যাতে তা’ কিছুতেই ছিন্ন না হয়। সব প্রতিকূলতার মধ্যে ঐ টানই আমাদের বাঁচায়।

এরপর নিরাপদদা (পাণ্ডা) মহিষাদলের একজন জ্যোতিষী শ্রীশ্রীঠাকুরের কোষ্ঠী সম্পর্কে যা’ বলেছেন তা’ বললেন।

সুশীলদাও ঐ সম্পর্কে বিভিন্ন জ্যোতিষীর গণনা সম্বন্ধে বললেন। আরো বললেন—বহু সৎসঙ্গীর কোষ্ঠীতেও তাদের গুরু-সম্বন্ধে অপূর্ব্ব সব উক্তি পাওয়া যায়, যা’ আপনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

শ্রীশ্রীঠাকুর—তাতে কী হবে? আমি বলি—আপনারা সুরক্ষিত হ’য়ে থাকুন এবং ইষ্টের রক্ষণ, পালন ও পোষণে সৰ্ব্বতোভাবে দক্ষ হ’য়ে উঠুন।

আসুরিক-সভ্যতা ও দেব-সভ্যতার পার্থক্য সম্বন্ধে কথা উঠলো।

শ্রীশ্রীঠাকুর—অসুরদের যা’-কিছুর করার মূলে ছিল আত্মস্বার্থ, আর দেবতারা যা’-কিছু করতেন ইষ্টার্থে। অসুররা আত্মকেন্দ্রিক ও দেবতারা ইষ্টকেন্দ্রিক। অসুররা শক্তিমান ছিল কিন্তু সে শক্তি ব্যয়িত হতো আত্মরক্ষায়, ইষ্টরক্ষায় নয়কো।

এক দাদা নানা পারিবারিক বিপর্যয় ও অসুখ-অশান্তির কথা বলছিলেন।

শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—আসল কাম বাদ দিলেই অমনি হয়। যে বাঁচাবে তাকেই তাড়াস।

প্রফুল্ল—আসল কাম মানে তো যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি?

শ্রীশ্রীঠাকুর—হ্যাঁ!

উক্ত দাদা—নানা ঝামেলার মধ্যে প’ড়ে আমার গোলমাল হ’য়ে গেছে।

শ্রীশ্রীঠাকুর—ঝামেলার মধ্যে পড়লে তো এইগুলি আরো জোর দিয়ে করা লাগে। ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার দিকে লক্ষ্য থাকলে অমঙ্গলও মঙ্গলের কারণ হ’য়ে ওঠে।
……

১৫ই আষাঢ়, ১৩৫৫, সোমবার (ইং ২৯/৬/১৯৪৮)

শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতে ভক্তবৃন্দ-পরিবেষ্টিত হ’য়ে তাঁর ঘরে শুভ্রশয্যায় উপবিষ্ট। কেষ্টদা (ভট্টাচাৰ্য্য) ইষ্টভৃতি সম্পর্কে শ্রীশ্রীঠাকুর-প্রদত্ত একটি বাণী প’ড়ে শোনালেন ।

শ্রীশ্রীঠাকুর—ইষ্টভৃতিতে intuitive function (অন্তর্দৃষ্টিমূলক শক্তি) enriched (সমৃদ্ধ) হয়।

কেষ্টদা—আমি যেমন দৈনিক পাঁচ টাকা ক’রে ইষ্টভৃতি করছি, তাতে আমার লেখার কাজ থেকে অনেকটা সময় ও শক্তি এদিকে এনে দিতে হচ্ছে। সেটা কম পড়ছে। কোন্‌টা ভাল?

শ্রীশ্রীঠাকুর—পাঁচ টাকা ইষ্টভৃতি করছেন, তার মানে দৈনন্দিন জীবনের সব কাজ চুইয়ে এটা আসছে। তাতে একটা intuitive impression (অন্তদৃষ্টিমূলক ছাপ) হ’চ্ছে, তার ফল সব কাজে পাবেন। আগে যেটা যে সময়ে পারতেন, তার ঢের কম সময়ে হয়তো সেটা সহজভাবে ক’রে ফেললেন। তাই এতে সব কাজের পক্ষেই ভাল হয়।

শৈলেনদা (ভট্টাচার্য)—একজন অন্যান্য সব কাজেই হয়তো আপ্রাণ, কিন্তু সে হয়তো ইষ্টভৃতির পরিমাণ বাড়ায়নি, তার কী হবে?

শ্রীশ্রীঠাকুর—ইষ্টভৃতি progressive (বৃদ্ধিপর) না হ’লে psychophysical concentration (মানসিক ও শারীরিক একাগ্রতা) progress (বৃদ্ধিলাভ) করে না।

কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন—ছোটকালে শুনেছিলাম এক মা স্বামী-সেবা ক’রে বিশেষ শক্তিলাভ করেছিলেন। কিন্তু তা’ তিনি জানতেন না। তিনি নিজের থেকেই বুঝে বুঝে স্বামীর সেবা করতেন, তাঁকে কিছুই বলা লাগত না। একদিন একজন সাধু এসেছেন, তিনি ভিক্ষা চাইলেন, মা-টি তখন স্বামী-চর্য্যায় রত, একটু দেরী করতে বললেন। কিন্তু সাধু তাতে চ’টে গেলেন। মনে-মনে ভাবটা এইরকম—আমি হেন শক্তিমান সাধু আর আমাকে অগ্রাহ্য করা। তখন মা-টি বললেন—আপনি না হয় কাক-বক ভস্ম করেছেন, তা’ ব’লে চটছেন কেন? আমি স্বামী সেবায় ব্যাপৃত আছি। একটু বসেন। হাতের কাজ শেষ হ’লেই আমি আসছি। সাধু তো একেবারে অবাক–এ এমনতর শক্তি পেল কোথায়? তখন তিনি কেঁদে ফেলে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘বলেন তো এ ক্ষমতা আপনি কিভাবে লাভ করলেন? আমার কথা তো কেউ জানে না।” মা বললেন—’আমি তো সাধনতপস্যা কিছু জানি না, আমি জানি স্বামী-সেবা, সেবায় তাঁকে তৃপ্ত করতে পারলে তৃপ্তি লাগে, এ না করলে ভাল লাগে না। আমি কোন শক্তিলাভের আশায় এটা করি না। আর, আমার যে কোন শক্তি আছে, তাও জানি না। তাঁকে সেবা করে শান্তি পাই, তাই করি।’

তাই গুরু বা গুরুজনের অনুরাগভরা, অতন্দ্র, অকুণ্ঠ সেবায় যে কি হয়। আর না হয়, তা’ বলা যায় না।
….