সত্যানুসরণ-এ থাকা শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীটি হলো:
সত্যকে আশ্রয় কর, আর অসত্যের অনুগমন ক’রো না—শান্তি তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে থাকবে না।
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা কর্তৃক ব্যাখ্যা :
শ্রীশ্রীপিতৃদেব গোলোকগুঞ্জনকে আলোচনা করতে আদেশ দিলেন।
গোলোকগুঞ্জন বাণীটি পুনরায় পাঠ করার পর শ্রীশ্রীপিতৃদেব বললেন—বাণীতে ঠাকুর বলছেন সত্যের ওপর আস্থা রেখো, অসত্যের পেছনে ধাওয়া করো না—তাহলে শান্তি তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে থাকবে না।
—সত্য কাকে বলে?
গোলোকগুঞ্জনকে নির্বাক থাকতে দেখে তিনি দ্বৈপায়নকে একই প্রশ্ন করলেন।
দ্বৈপায়ন—যা’ জীবন-বৃদ্ধির সহায়ক।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—শান্তি কাকে বলে?
দ্বৈপায়ন—শান্তি মানে তৃপ্তি। শান্তি মানে মঙ্গল।
—কী রকম মঙ্গল, বুঝিয়ে বলবে তো। মঙ্গলই বা কেমন ক’রে হ’ল?
—যাদের ধন-দৌলত আছে তারা শান্তি পায় না। ধন থাকলে চোর-ডাকাতের ভয় থাকে।
—কিন্তু এমন লোক আছে ধন-দৌলত আছে, তবু শান্তি নেই। ধনও নাই, শান্তিও নাই এমন উদাহরণও দেখা যায়। তাহলে শান্তি কেমন জিনিস? বল, শান্তি কী?
—যা’ জীবন-বৃদ্ধির পথে অভাব মেটায়।
—ধন-সম্পদও তো জীবন-বৃদ্ধির পথে অভাব মেটায়। ধন-সম্পদ দিয়ে মানুষ খেয়ে-পরে চলতে পারে, জীবন-বৃদ্ধির পথে যেতে পারে; আবার ধন-সম্পদ থাকলে মানুষ আপদগ্রস্তও হ’তে পারে। যারা সৎ-নিয়ন্ত্রিত নয় তাদের বিপদ সর্বদাই থাকে,—ধন-সম্পদ থাকলেই বা কি, না থাকলেই বা কি! গোলোকগুঞ্জন, তাহলে বল এবার—শান্তি কেমন ক’রে আসে?
গোলোকগুঞ্জন—জীবন-বৃদ্ধির পথে চললে শান্তি পাওয়া যায়।
শ্রীশ্রীপিতৃদেব—কেমন ক’রে হয় তা’ তো বললে না! আগে তো নিজেকে শান্ত হ’তে হয়, তাহলে শান্তি পাওয়া যায়। সত্য মানে ইষ্ট। ইষ্টই কল্যাণ ও মঙ্গলের মূর্ত প্রতীক। তাঁকে যদি আশ্রয় ক’রে চলি, জীবন-বৃদ্ধির পথ ধ’রে চলতে পারব। কল্যাণ ও মঙ্গলকে লাভ করা যাবে। কারণ, সত্যকে আশ্রয় ক’রে চললে মন চঞ্চল হয় না, শান্ত হয়। জীবন-বৃদ্ধির মূর্ত প্রতীক যিনি তিনি যদি সর্বদা আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত থাকেন তাহলে প-র-ম আনন্দ লাভ করা যায়। তিনিই আনন্দময়। তিনিই মূর্ত মঙ্গল। তিনিই মূর্ত শান্তি।
সত্যপথে না চললে আমরা রিপুর কবলে পড়ি। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য এগুলো রিপু—এগুলো সব শত্রু। এছাড়া অষ্টপাশ আছে। এরা সবাই আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। যখনই সত্যকে আশ্রয় ক’রে চলি তখন এদের বাঁধন খুলে যায়। তখন আনন্দ পাই, মুক্তি পাই, আর তা’তেই শান্তি। সত্যকে আশ্রয় ক’রে চললে যে অশান্তি নাই, তাও না! সত্যপথে চলতে গেলেও অনেক ঠাট্টা-উপহাস সহ্য করতে হ’তে পারে। প্রকৃতপক্ষে অন্যের জন্য দুঃখ-কষ্ট ভোগ করা অশান্তি নয়, তা’ বরঞ্চ আনন্দের। শান্তি পাই তখনই যখন ইষ্টের জন্য, ঠাকুরের জন্য, সবরকম দুঃখকষ্ট ভোগ করতে রাজি থাকি। ঠাকুরের মন্দির তৈরি হচ্ছে—কখন কীভাবে তার মন্দিরের জন্য অর্ঘ্য দিতে পারব—এই যে উদ্বেগ, এতেই শান্তি। অশান্তি কখন হয়—যখন তাঁর ইচ্ছাকে খর্ব ক’রে চলার চেষ্টা করি।
[ ইষ্ট-প্রসঙ্গে/তাং-২/১০/৭৬ ইং ]
[প্রসঙ্গঃ সত্যানুসরণ পৃষ্ঠা ২৭৬ – ২৭৭]